বৃহস্পতিবার, মে ৯, ২০২৪
spot_imgspot_img
Homeস্মরণালোকশিবপুরের কৃতী সন্তান রবিউল আউয়াল খান কিরণ

শিবপুরের কৃতী সন্তান রবিউল আউয়াল খান কিরণ

১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান তিনি। এমন সময় ২৮ এপ্রিল নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের খড়ামারা নামক স্থানে কলাগাছিয়া নদীর উপর নির্মিত সিএন্ডবি ব্রিজের উপর আততায়ীরা আকস্মিক গুলি চালিয়ে হত্যা করে তাঁকে।


রবিউল আউয়াল খান কিরণ শিবপুরের রাজনৈতিক গগনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি ছিলেন জনমানুষের অত্যন্ত কাছের এবং সকলের আস্থাভাজন প্রিয় নেতা। তাঁর অবস্থান ছিলো শিবপুরের প্রতিটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মাটি ও মানুষের সাথে। শিবপুরের যশস্বী ব্যক্তিদের মধ্যে কিরণ খান ছিলেন অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশ ও শিবপুরের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন তিনি। সেইসাথে সাধারণ জনগণের অত্যন্ত কাছের ও প্রিয়ভাজন নেতা হিসেবে সর্বমহলে ছিলেন সমাদৃত।

শিবপুরের এই কৃতী সন্তান বিংশ শতকের চল্লিশের দশকে শিবপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী মজলিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মো. আতাউর রহমান খান এবং মায়ের নাম রহিমা খানম। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে উপজেলা সদর শিবপুর পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৬১ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। অতঃপর ভর্তি হন প্রাচ্যের দ্বার খ্যাত চাঁদপুর জেলা সদরস্থ চাঁদপুর কলেজে। তাঁর চাচা তখন ব্যবসায়িক প্রয়োজনে চাঁদপুর বসবাস করতেন বিধায় আদরের ভাতিজাকে সাথে নিয়ে যান। তৎকালীন মহকুমা শহরের চাঁদপুর কলেজে অধ্যয়নকালে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় তাঁর এবং সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। ছাত্র নেতৃত্বে তাঁর সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং যোগ্যতর নেতা হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৎকালীন চাঁদপুর মহকুমার ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলন শুরু হলে বলিষ্ঠভাবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্ব দেন। এ-কারণে তাঁর বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার সাতটি মামলা রজ্জু করে হুলিয়া জারি ও গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কিন্তু জনতার আন্দোলনের মুখে পরবর্তীতে তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় তারা।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধের প্রারম্ভেই তিনি ভারতে চলে যান এবং আগরতলার বড়মারা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের ইনচার্জ নিযুক্ত হন। সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে পুনরায় চাঁদপুর ফিরে আসেন এবং চাঁদপুর মহকুমার বিএলএফ কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

রবিউল আউয়াল খান কিরণ বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি’র কাছের মানুষ হিসেবে সহযোগিতা করা-সহ যুবলীগকে সুসংগঠিত করেন। দেশ স্বাধীন হবার অব্যবহিত পরে রবিউল আউয়াল খান কিরণ চলে আসেন জন্মস্থান শিবপুরে, শিবপুরের স্থানীয় রাজনীতির বিশেষ প্রয়োজনে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নরসিংদী-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নরসিংদী-৩ আসন (শিবপুর ও রায়পুরার অংশবিশেষ)-এর মানুষ তাঁকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। নির্বাচিত হবার পর এলাকার উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগী হন তিনি এবং জনকল্যাণের আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। ঐ-সময় তাঁর বদান্যতায় দলমত নির্বিশেষে অনেকেই তাঁর সহযোগিতায় চাকুরি পেতে সমর্থ হয়েছিলো। তিনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ শিবপুরের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করতে থাকেন। শিবপুর শহীদ আসাদ কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্ন হতেই তিনি এ-কলেজের মানোন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছিলেন। কিরণ খান তাঁর নেতৃত্বের বহুবিধ গুণাবলির কারণে সকল মানুষের আস্থাভাজন হন এবং একসময় নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।

১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের প্রায় দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান তিনি। এমন সময় ২৮ এপ্রিল নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। ফেরার পথে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের খড়ামারা নামক স্থানে কলাগাছিয়া নদীর উপর নির্মিত সিএন্ডবি ব্রিজের উপর আততায়ীরা আকস্মিক গুলি চালিয়ে হত্যা করে তাঁকে। তিনি শহীদ হন।

রবিউল আউয়াল খান কিরণের প্রিয় শিবপুর আজো বর্তমান, কিন্তু তিনি নেই। তিনি শিবপুরকে নিয়ে আর ভাবতে পারেন না। যেখানে তিনি চলে গেছেন, সেখান থেকে ফিরে আসবেন না আর কোনোদিনই। মনে হয়, তিনি চেয়ে আছেন শিবপুরের সর্বত্র এবং জনমানুষের সাথে করছেন সুহৃদ আলিঙ্গন। তাঁকে শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্ন করলেও জনগণের মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি এবং হবেও না কোনোদিন। শিবপুরের জনগণের মানসপটে তিনি রয়েছেন চির অম্লান এবং থাকবেন চির ভাস্বর।


লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার।

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here