সুখ আসে মনে, জ্ঞান পাওয়া যায়, এই জন্যই গাই।
বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির অকৃত্রিম অনুষঙ্গ ‘গাজীর পট’-এর গায়েন দুর্জন আলী, মৃত্যুবরণ করেন ২০১৭ সালের ৩০ জানুয়ারি। এ-বছর তাঁর মৃত্যুর ৭ বছর পূর্ণ হলো। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই মহান শিল্পী তাঁর কাজে পূর্ণ সক্রিয় ছিলেন। ছোটোখাটো দোহারা গড়নের এই মানুষটি খুবই বড়ো মনের ছিলেন। পেশা ছিলো বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাতা মেরামত করা। থাকতেন নরসিংদীর হাজীপুরে, এক জীর্ণ কুটিরে। সাথে থাকতেন তাঁর ছোটো ভাই আরেক কিংবদন্তী গায়েন কোনাই মিয়ার পুত্র ফজল মিয়া ও তাঁর পরিবার। জীর্ণাবস্থায়, দরিদ্রাবস্থায় দিনাতিপাত করেও এই শিল্পী মানুষটি তাঁর মনের ভিতরে অফুরান প্রেম ও মানবিকতার রসের ধারা বহমান রেখে চলতেন। ২০১৫ সালে, যখন তাঁর সাথে প্রথম সাক্ষাত ঘটে, তখনই পেয়েছিলাম এই শিল্পীমনের পরিচয়।
লোকশিল্প গবেষক তোফায়েল আহমদ কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে ‘গাজীর পট’ দেখতে যান। আশুতোষ মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ দাবি করে, দুই বাংলার এই একটি গাজীর পটই অবশিষ্ট আছে। গবেষক তোফায়েল আহমদ এই তথ্য মেনে নিতে পারেননি। দেশে ফিরে খুঁজতে থাকলেন পটচিত্রী আর পট পরিবেশনা সম্প্রদায়। সারাদেশের পটচিত্রের ইতিবৃত্ত খুঁজতে গিয়ে লোকসংস্কৃতি গবেষক তোফায়েল আহমদ এবং তাঁর দলের সঙ্গী সমাজকর্মী হামিদা হোসেন, শিল্পী কালিদাস কর্মকার নরসিংদীর হাজীপুর গ্রামের বেদেপাড়ায় খুঁজে পান পটকুশীলব দুর্জন আলী এবং কোনাই মিয়াকে। এসব ঘটনা সেই সত্তর দশকের। তাঁদের সূত্র থেকেই ১৯৮০ সালে খুঁজে পাওয়া যায় মুন্সিগঞ্জের কমলাঘাটের কাঠপট্টির কালিন্দীপাড়ায় পটচিত্রী সুধীর আচার্য এবং তাঁর ছেলে শম্ভু আচার্যকে। দুর্জন আলীর কাছে যে-পটচিত্রটি দেখতে পেয়েছিলাম, তা শম্ভু আচার্যের আঁকা। বর্তমানে এই চিত্রটি গায়েন ফজল মিয়া ও তাঁর দল ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশে হাতেগোনা যে-ক’জন গাজীর পটশিল্পী ছিলেন, দুর্জন আলী ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অনেকে মনে করেন, তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গাজীর পটের শেষ সূর্যটি অস্তমিত হয়েছে।
দুর্জন আলীর জন্ম ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর ভাই কোনাই মিয়াও ছিলেন পটকুশীলব। দুর্জন আলী এবং কোনাই মিয়ার বাবা আনোয়ার আলী। কয়েক পুরুষ যাবত তাঁরা নরসিংদীর হাড়িধোয়া-মেঘনা নদীর তীরে হাজীপুর গ্রামের বেদেপাড়ায় বসবাসরত। তাঁদের পূর্বপুরুষের আবাসস্থল ছিলো বৃহত্তর কুমিল্লার রামচন্দ্রপুরের দুলালপুর গ্রাম। দুর্জন আলী ও কোনাই মিয়ার ওস্তাদ কুমিল্লার জাফরগঞ্জের আবদুল হামিদ। কোনাই মিয়া অনেক আগেই প্রয়াত হয়েছেন। তাঁদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বেদে সম্প্রদায়ের। দুর্জন আলী কখনো ছাতা সেলাইয়ের কাজ করতেন, কখনো সবজি বিক্রি করতেন, কখনো করতেন মুটে-মজুরের কাজ। দুর্জন আলী ছিলেন নিঃসন্তান।
দুর্জন আলীর সৌভাগ্য হয়েছিলো, ১৯৯৯ সালে ব্রিটেনে ‘বাংলাদেশ উৎসব’-এ বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হয়ে গাজীর পটের গায়েন হিসেবে যোগদান করার।
ফজল মিয়া ও তাঁর দল
দুর্জন আলীর মৃত্যুর সাথে সাথে এ-অঞ্চল থেকে একটা যুগের অবসান হয়ে গিয়েছিলো, এরকম ধারণা ছিলো আমাদের। কিন্তু সম্প্রতি দুর্জন আলীর ভাতিজা ফজল মিয়ার ‘গাজীর পট’ নিয়ে নতুন দল গড়ার কথা জেনে নতুন আশার সঞ্চার হলো। গত ডিসেম্বরে নরসিংদী পৌর পার্কে নরসিংদী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আয়োজিত ‘গাজীর পট আসর’ দেখে পরদিন চলে গেলাম তাঁর বাড়ি হাজীপুরে। নয় বছর পর সেই একই ঘর, একই পরিবেশ দেখে স্মৃতিকাতর হলাম। ফজল মিয়াকে অভিনন্দন জানালাম মহান শিল্পী দুর্জন আলীর এই কীর্তি ধরে রাখার জন্যে।
ফজল মিয়ার ছেলে দুটো এখন বড়ো হয়েছে। তবে ততোটা বড়ো নয়। কিশোর বলা যায়। তাদের নিয়েই সে গঠন করেছে তাঁর গাজীর গীতের দল। তাঁর দলের সদস্যরা হলেন : বড়ো ছেলে মো. আবদুল্লাহ, ছোটো ছেলে মো. হাবিবুল্লাহ ও করতাল বাদক মো. আঙ্গুর মিয়া।
ফজল মিয়ার কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা ছিলো, কেন এখনো ধরে রেখেছেন এই শিল্পটি…? তিনি বলেন, “ভালো লাগে, মনে আনন্দ পাই, সেজন্যই এই গান করি।” এই বাক্য শুনে সহসা মনে পড়ে গিয়েছিলো নয় বছর আগের দুর্জন আলীর কাছে শোনা একই অমোঘ বাক্য, “সুখ আসে মনে, জ্ঞান পাওয়া যায়, এই জন্যই গাই।” একজন প্রকৃত শিল্পীর যথাযথ উপলব্ধি!
ফজল মিয়া আরো জানান, “বাপ-দাদারা এই গান কইরা গেছেন। তাঁদের স্মৃতিকে ধইরা রাখতে হইবো। এটা আমাদের সম্পদ। আমি যতোদিন বাঁইচা থাকমু, এই গান করমু। আমার মৃত্যুর পর আমার পোলারা করবো, যদি তারা চায়।”
ফজল মিয়া আলাপে আরো জানান, তিনি তাঁর পুরোনো পেশা ছাতা মেরামতের পাশাপাশি এখন গাজীর গীতকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এখন নানা স্থান থেকে তাঁর ডাক আসে গান গাওয়ার জন্যে। গত এক-দেড় বছরের মধ্যে তিনি সোনারগাঁ, ময়মনসিংহ, ঢাকা ইত্যাদি জায়গায় গান করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়, শিশু একাডেমি মিলনায়তনে সম্প্রতি গাজীর গীত পরিবেশনের খবর তিনি জানান।
মহান শিল্পী দুর্জন আলীর স্মৃতি জাগরূক রাখতে ফজল মিয়া ও তাঁর দল বাংলাদেশের এই লোকপরম্পরার গীতধারাটিকে আর নরসিংদীর এই স্থানীয় সম্পদকে সবসময়ই ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন, পাশাপাশি আরো অনেকের মাঝে ছড়িয়ে দেবেন, এই প্রত্যাশা রেখেই নরসিংদীর হাজীপুরের পশ্চিমপাড়া তালতলার মাঠের পাশে তাঁর কুটির থেকে আমরা বেরিয়ে আসি।
জয়তু দুর্জন আলী
জয়তু ফজল মিয়া
জয়তু গাজীর পট।