দু’পাশে সবুজের দেয়াল, তার ভেতরে হলদে শস্যের ক্ষেত, নরম রোদ পিঠে নিয়ে কর্মচঞ্চল মানুষের আনাগোনা— বাংলার চিরকালীন এই প্রচ্ছদপটের ঠিক মাঝ বরাবর কালো পিচের রাস্তায় ধীর লয়ে চলছে আমার বাইক। পেছনে বসে আছেন কবি ও সম্পাদক সুমন ইউসুফ। আমাদের পেছনে গাড়িতে আছেন নরসিংদী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ গোলাম মোস্তাফা মিয়া, সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার নূরুদ্দীন দরজী, ভাই গিরিশচন্দ্র সেন গণপাঠাগারের সভাপতি মোহাম্মদ শাহীনুর মিয়া এবং শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী নাজমুল আলম সোহাগ। গন্তব্য দত্তেরগাঁও। পূর্ব নির্ধারিত সময়ে গত ৬ ডিসেম্বর ২০২৩ (শনিবার) সকাল দশটায় আমরা একত্র হই নরসিংদীর উপজেলা মোড়ে। জনাব নূরুদ্দীন দরজী দত্তেরগাঁও থেকে তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে আগেই চলে এসেছিলেন। তাঁর গ্রামেই বেড়াতে যাচ্ছি মূলত।
অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই শিবপুর কলেজ গেইট। শিবপুর সরকারি শহীদ আসাদ কলেজ এবং শহীদ আসাদ কলেজিয়েট গার্লস হাই স্কুল এন্ড কলেজে ছিলো আমাদের বিরতি। দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানই আমাদের যথেষ্ট আতিথেয়তা ও আন্তরিকতার সাথে তাঁদের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও অবকাঠামো ঘুরিয়ে দেখান। উল্লেখ্য যে, প্রতিষ্ঠান দুটি শিবপুরের শিক্ষা বিস্তারে অবর্ণনীয় ভূমিকা রেখে চলেছে। সেখান থেকে বেরিয়ে চলে যাই একসময়ের তুখোড় ছাত্রনেতা ও রাজনীতিক আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার সমাধিস্থলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও তৎপরবর্তী রাজনীতিতে যাঁর অবদান অপরিসীম। তারপর ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শহীদ আসাদের সমাধি দর্শন শেষে আমরা ঢুকে পড়ি দত্তেরগাঁওয়ের গহীন সৌন্দর্যারণ্যে।
দত্তেরগাঁও কাচারি বাজারে আমরা নেমে পড়লাম। চা পান করতে করতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম বাজারের অলি-গলিতে। নানা মানুষের সাথে কথাবার্তা হলো। কাচারির ধ্বংসস্তূপ থেকে ইতিহাস যেন ঠিকরে বেরোচ্ছিলো। নূরুদ্দীন দরজীরই এক লেখা থেকে জানতে পারি, “শিবপুর সদর হতে ৩ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত এই কাচারি একসময় জমিদারদের সুবিধার্থে চালু হয়েছিলো। কবে, কখন দত্তেরগাঁও কাচারি চালু হয়েছিলো, এখন তা আর কেউ বলতে পারে না। অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে কাচারিটি সর্বশেষ খাজনা আদায় করে দিতো পুরান ঢাকায় বসবাসকারী জমিদার বাবু রশিক মোহন চক্রবর্তী ও বাবু মোহনী মোহন চক্রবর্তীকে। …তখনকার দিনে কাচারিতে বহুমুখী কর্মকাণ্ড হতো। এখানে যাতায়াত ছিলো জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনির। …১৯৫৬ সালের পর জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের ফলে জমিদারসহ সবাই এসব কর্মকাণ্ড থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়েন।”
বাজার থেকে চলে আসি দত্তেরগাঁও উচ্চ বিদ্যালয়ে। দত্তেরগাঁও ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এ-বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সফিকুল ইসলাম খান আমাদের দোতলায় নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে আমরা হতভম্ব। দত্তেরগাঁও গ্রামে আমাদের আগমন উপলক্ষে রীতিমতো সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন জনাব নূরুদ্দীন দরজী ও বিদ্যালয়-সংশ্লিষ্টজনেরা। যাই হোক, কোরান তেলাওয়াত, মানপত্র পাঠ, কবিতা আবৃত্তি এবং কথাবার্তার মাধ্যমে সভা শেষ হয়। উপস্থিত ছিলেন বিদ্যালয়ের সভাপতি মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া, স্থানীয় মেম্বার ফাইজুল ইসলাম ভূঁইয়া চান মিয়া, বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ। অনুষ্ঠানে পঠিত মানপত্র মারফত দত্তেরগাঁও গ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সমকালীন ধারা সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা পাই।
দত্তেরগাঁও একটি ঐতিহ্যবাহী গ্রাম। এ-গ্রামের রয়েছে শত শত বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত সুষমা। সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে যাওয়া ‘কানাই ডিঙি’ নদীর বুক চিরে অবস্থান করা এই গ্রামের নামকরণ হয়েছে একসময়ের দত্ত বংশীয়দের নামানুসারে। আবার বাংলার নবাব মুর্শিদ কুলী খাঁ এ-গ্রামে তাঁর এক পালিত কন্যা বিবাহ দিয়ে ইচ্ছেকৃত যে-দত্তক দিয়েছিলেন, তা থেকে দত্তেরগাঁও নাম হয়েছে বলেও মনে করেন অনেকে। নানা ধর্মের, নানা জাতের, নানা পেশার মানুষ এই গ্রামে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছে সুদীর্ঘকাল ধরে।
স্কুল থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যাই নূরুদ্দীন দরজীর বাড়িতে। ছায়া-সুনিবিড় ‘রুবী কুঞ্জ’-এ ফুলের তোড়া দিয়ে আমাদের বরণ করে নেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। দুপুরে বেরহম খাওয়া-দাওয়ার পর বেরিয়ে পড়ি গ্রামের দক্ষিণে— সুবিশাল মাঠের বন্দের দিকে। শীতের ঠিক আগে আগে কেটে ফেলা ধানের স্তূপ আর কর্মচাঞ্চল্য পেরিয়ে বিস্তৃত মাঠের প্রান্তে দাঁড়ালাম, হেঁটে গেলাম ধানের গোছা পায়ে মাড়িয়ে। বিকেলের ঝিমধরা আলো আর সন্ধ্যার অন্ধকারের মধ্যিখানে আমরা বেশ সময় কাটালাম দুশো বছরেরও বেশি বয়স্ক ঢাউস সাইজের জামগাছের নিচে। এই গাছের যে কতো গল্প, তা নিমিষেই ভেসে ওঠলো আমাদের চোখে।
মাঠের বন্দ থেকে ফেরার পথে গেলাম অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা মিয়ার শিক্ষক, শিবপুর সরকারি শহীদ আসাদ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও শিবপুরের শিক্ষা বিস্তারে অনন্য ভূমিকা পালনকারী নূরুল ইসলাম খান (শাহজাহান)-এর বাড়িতে। তিনি গত হলেও তাঁর পরিবারের সদস্যরা আমাদের আতিথেয়তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নতুন চালের চিতুই পিঠা আর গরুর মাংসের স্বাদ আমাদের বিমোহিত করলো।
সবশেষে, সন্ধ্যার পর অন্ধকারের প্রাবল্য কেটে আমরা ফিরতি পথে রওনা হলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম দত্তেরগাঁওয়ের অমোঘ সৌন্দর্য আর গ্রামের সহজ মানুষের সহজাত আতিথেয়তা ও ভালোবাসা।