সোমবার, মে ২০, ২০২৪
spot_imgspot_img
Homeইতিহাসের পথ ধরেশিবপুরের গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতা | পর্ব ৯

শিবপুরের গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতা | পর্ব ৯

স্থানীয় নানা শ্রেণির মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত বই ও দলিল ঘেঁটে যাচাই-বাছাইপূর্বক এসব তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। কারো দৃষ্টিতে কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে এবং সঠিক তথ্য দিতে পারলে বিচার-বিশ্লেষণের আলোকে সংশোধনে আপত্তি থাকবে না। লেখার কলেবর বৃহৎ হওয়ায় লেখাটি চলছে ধারাবাহিকভাবে।

শিবপুরের গ্রাম ও গ্রামের উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন দিক নিয়ে এ-পর্যায়ে আমাদের আলোচনা চলে এসেছে দুলালপুর ইউনিয়নে। দুলালপুর শিবপুর উপজেলার সবচেয়ে বৃহৎ ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নে রয়েছে বহু গ্রাম।

প্রথমেই আসা যাক দুলালপুর নামকরণের কথায়। প্রায় দুইশত বছর আগের কথা। এলাকায় বাস করতেন দুলালচন্দ্র দত্ত এবং পুরান্বনী দত্ত নামে দুজন সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোক। তাঁদের প্রচেষ্টায় তখন এলাকার টোল বা পাঠশালা প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষার উন্নয়নসহ প্রচুর উন্নয়ন হয়েছিলো। অনেকের ধারণা, তাঁদের একজন সম্মানিত দুলালচন্দ্র বা আদরের দুলাল নাম থেকে গ্রামের নাম রাখা হয়েছে দুলালপুর। তখন থেকেই দুলালপুর নামটি সবার প্রিয় ও উচ্চারণে আনন্দ বয়ে আনছে। এই পর্ব থেকে দুলালপুর ইউনিয়নের গ্রামগুলো নিয়ে আলোচনা করবো।

প্রথমেই বৃহত্তর গ্রাম দুলালপুর। এ-গ্রামে অনেকগুলো পাড়া আছে। দুলালপুর দড়িপাড়া, মধ্যপাড়া, উত্তরপাড়া, খালপাড়, বিলপাড় ইত্যাদি।

দুলালপুর গ্রামের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে দুলালপুর দড়িপাড়া। একসময় এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পাট উৎপন্ন হতো। সেই পাটের গুণাগুণের সুখ্যাতি ছিলো। পাটের পাকানো দড়ি খুবই শক্ত ও মজবুত হতো। আশেপাশের এলাকায় দুলালপুরের দড়ির কদর অনেক বেশি ছিলো। বলা হয়, সেই দড়ির জন্যেই গ্রামের নাম হয় দুলালপুর দড়িপাড়া। তখন সব মানুষ তেমন সচ্ছল ছিলো না। সময়ের পরিক্রমায় দড়িপাড়ায় এখন আর দড়ি নয়, প্রচুর বালু উত্তোলন করার সুযোগ এসেছে। এখানকার বালু খুবই উৎকৃষ্ট মানের এবং সব জায়গায় সমাদৃত। গ্রামের দড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮৬ সালে। প্রতিষ্ঠাতাদ্বয় হচ্ছেন আবদুল বাতেন ও মো. বাতেন ফকির। জমি দিয়েছেন বাতেন ফকির। প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক হাছিনা খাতুন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সিনিয়ন ফুড কন্ট্রোলার বাবুল আহমদ দড়িপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কৃতি শিক্ষার্থী ছিলেন। তানজিলা খানম রিক্তা দীর্ঘদিন যাবত দুলালপুর দড়িপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে সুনামের সহিত কাজ করে যাচ্ছেন। লোককাহিনিভিত্তিক সংস্কৃতির পালাকার প্রথিতযশা মরহুম ছানাউল্লাহ কমান্ডার দুলালপুরের কৃতি সন্তান।

মধ্যপাড়ায় রয়েছে প্রখ্যাত দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান— দুলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও দুলালপুর উচ্চ বিদ্যালয়। সমসাময়িকদের মতামতে জানা যায়, দুলালপুর গ্রামের দত্তপাড়ায় ১৮৫০ সাল থেকেই টোলের মাধ্যমে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিলো। তারই ধারাবাহিকতায় দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান দুলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৮৫০ সালে ছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। ইংল্যান্ডের রাণী ছিলেন ভিক্টোরিয়া। অন্যদিকে বাংলার গভর্নর ছিলেন ডালহৌসি নামের এক চতুর শাসক। তার কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ছিলো একেবারে পশ্চাৎপদ। তখন কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতে থাকা বর্তমান দুলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি সামান্য আলোর মুখ দেখে ব্রিটিশরা এ-দেশ থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর। দুলালপুরের কিংবদন্তী মরহুম কাজেম আলী মাস্টারের প্রচেষ্টায় ও মরহুম এবাদুল্লাহ পণ্ডিতসহ অন্যান্য অনেক বিদ্যোৎসাহীর সহায়তায় বর্তমান দুলালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আত্মপ্রকাশ করেছিলো। এলাকার শিক্ষা বিস্তারে সর্বজন শ্রদ্ধেয় কাজেম আলী মাস্টারের নাম মানুষের হৃদয়ে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। এই প্রতিষ্ঠানের জন্যে জমি দিয়েছিলেন স্বর্গীয় শ্রী শরৎচন্দ্র দত্ত, শ্রী সুবোধ চন্দ্র দত্ত এবং বৃহৎ চন্দ্র দত্ত। উল্লেখযোগ্য আরো ছিলেন আ. লতিফ মাস্টার, তোফাজ্জল হোসেন মাস্টার, কেরামত আলী পণ্ডিত, কাশেম আলী পণ্ডিত ও আ. ছাত্তার মাস্টার। পুরাতন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিবপুরের কৃতী সন্তান, বাংলাদেশের বিশিষ্ট রাজনীতিক, সাবেক সফল মন্ত্রী আবদুল মান্নান ভূঁইয়া এ-বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। ছাত্রদের মধ্যে আরো ছিলেন কিংবদন্তী চেয়ারম্যান মমতাজ উদ্দিন, তাঁর ছেলে শিল্পপতি জাকির উদ্দিন আহমেদ, ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম, মরহুম রবিউল্লাহ ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. ইলিয়াছুর রহমান ভূঁইয়াসহ অনেকে। মরহুম চেয়ারম্যান নাজিম উদ্দিন আহম্মেদ মুকুল এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।

দুলালপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬৭ সালে। মরহুম কাজেম আলী মাস্টারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও শিক্ষানুরাগী অন্যান্যদের সহায়তায় বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি যেসব প্রতিকূলতা ও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন, সেসব মানুষের মুখে মুখে। শ্রদ্ধেয় কাজেম আলী মাস্টার এ-বিদ্যালয়ে বলতে গেলে বিনা বেতনে শিক্ষকতা করেছেন। দুলালপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কাজেম আলী মাস্টার নাম দুইটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একই গ্রামের অধিবাসী মো. মোজাম্মেল হক খন্দকার দুলালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন সুনামের সহিত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

দুলালপুর সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা একটি পুরাতন মাদরাসা। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৫১ সালে, মরহুম আজফার আলী ফকিরের হাত ধরে। প্রতিষ্ঠালগ্নে সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন মৌলানা মো. ইদ্রিস আলী। মো. মনজুর হোসেন ফকির দীর্ঘদিন এ-প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। বহু কৃতী ছাত্রছাত্রী এখানে পড়াশোনা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ম্যাজিস্ট্রেট মো. সামসুল ইসলাম, ঢাকা হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের প্রিন্সিপাল আ. বাতেন, সোনালী ব্যাংকের জিএম মো. নূরউদ্দিন।


নূরুদ্দীন দরজী
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here