সোমবার, মে ২০, ২০২৪
spot_imgspot_img
Homeস্মরণালোক’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ আসাদ

’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ আসাদ

পৃথিবীতে অনেক মানুষের জীবন-সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ একটি জাতির জন্যে আকাশছোঁয়া জাগরণ সৃষ্টি করেছে। জাতিকে মুক্তির পথ দেখিয়েছে। একটি আত্মত্যাগ পরাধীনতার গ্লানি মুছে দিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। তেমনি শহীদ আসাদ ছিলেন বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তোলার অন্যতম অগ্রদূত। তাঁর আত্মদানের টগবগে রক্তস্রোতে ভেসে বাঙালিরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো বেনিয়া পাকিস্তানিদের রুখতে, তাদের শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্ত হতে।

বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্যে আসাদের ছিলো অফুরন্ত দরদ আর সীমাহীন ভালোবাসা। আসাদ অনুভব করতেন বাংলার সবুজ বনানী, উদার আকাশ, নির্মল আলো, স্নিগ্ধ বাতাস, নদীর পালতোলা নৌকা, মাঠের সোনালি ফসল এবং সহজ-সরল মানুষের জীবন। ভাবতেন অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্য, অবারিত বর্ণিল সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা ও প্রাচুর্যে ভরা দেশের মানুষের পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ থাকার কথা। প্রায় দুইশত বছর ইংরেজ শোষণ-শাসন আর পাকিস্তানের জুলুম-নির্যাতনের যাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালির দুর্দশা আসাদের মনে গভীর বেদনার ক্ষতে পরিণত হয়েছিলো। ১৯৬৯ সালে তাঁর আত্মাহূতি শুধুই বাঙালির মুক্তির জন্যে।

পাকিস্তানের দুঃশাসক তাদের কথিত লৌহমানব আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠেছিলেন আমানুল্লাহ মোহাম্মদ আসাদ। কারণ শোষকদের অবিচার, অত্যাচার, শোষণ ও শাসনে বাংলার মানুষের প্রাণ হয়ে ওঠেছিলো ওষ্ঠাগত। নিজেদের অধিকার আদায়ে দেশের মানুষ ঘর ছেড়ে নেমে এসেছিলো রাজপথে। মিছিল-মিটিং ও শ্লোগানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল যখন ছিলো সরগরম, যখন ১৯৬৯-এর ২০ জানুয়ারি ঢাকার বটতলায় মিছিলের অগ্রভাগে থেকে দিয়ে যাচ্ছিলেন নেতৃত্ব, ঠিক তখনই আইয়ুব খানের পেটোয়া বাহিনি আসাদের বুকে গুলি করে তাকে হত্যা করে। বাংলা মায়ের এই বীর শহীদ হন। আসাদ শহীদ হওয়ার সংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। এ-সংবাদে সারা বাংলার মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে ওঠে। তাঁরা শপথ নেয় বজ্রকঠিন। তখন থেকেই বাংলা হয়ে পড়েছিলো রণক্ষেত্র। মানুষ তাদের স্বাধিকার আদায়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সর্বত্র। আইয়ুব খান আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা আর বেশিদিন টিকে থাকতে পারলো না। বিদায় নিতে হলো। এরপর মাত্র পরবর্তী আড়াই বছরে সশস্ত্র যুদ্ধ করে বেঈমানদের চিরতরে বিদায় করে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়।

পাকিস্তানিরা আসাদের রক্তের তেজস্ক্রিয়তায় বাংলা থেকে সরে যেতে বাধ্য হবার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলো। যেমনটি সুভাষ বসুর আজাদ হিন্দ ফৌজের ভয়ে ব্রিটিশরা ভারত তথা বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে তড়িঘড়ি করেছিলো। আজাদ হিন্দ ফৌজ এ-দেশে অবস্থানরত ব্রিটিশদের ঘুম হারাম করে দিয়েছিলো।

আজ আমাদের দেশ স্বাধীন ‘বাংলাদেশ’। এ-দেশের মাটি শুঁকলে এখনো আসাদের রক্তের ঘ্রাণ পাওয়া যায়। শহীদ আসাদ এমন একটি নাম, যে-নাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাঙালির সংগ্রাম ও বাংলাদেশের ইতিহাস আলোচনা করলে নরসিংদীর সন্তান শহীদ আসাদ প্রসঙ্গে কথা বলতেই হয়। তেমনিভাবে বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় আসে কবি শামসুর রাহমান ও কথাসাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদের প্রসঙ্গ।

আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বর্ণবাদের করাল গ্রাস থেকে তাঁর দেশকে মুক্ত করতে জীবন দিয়ে পৃথিবীর বুকে অমর হয়ে আছেন। মার্টিন লুথার কিং একই কারণে দাসত্বের অবসান ঘটাতে জীবন উৎসর্গ করে ইতিহাস সৃষ্টি করে জীবন্ত হয়ে আছেন। তাদের আরেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি সমাজে সিভিল রাইটসকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। নেলসন ম্যান্ডেলা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সারা জীবন সংগ্রামের মাধ্যমে নিগ্রোদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি মানুষে মানুষে সমতা আনয়নে ব্রতী হয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থায়ী আসন গেড়ে আছেন। এমন আরো অনেকের মতো শহীদ আসাদও ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানে জীবন বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতার পথ সুগম করে বাংলার আকাশে উজ্জ্বল জ্যোতি হয়ে আছেন। মাত্র ২৭ বছরের (১৯৪২-১৯৬৯) জীবনে জ্ঞান হবার পর থেকেই তিনি বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন নিজেকে। ব্যক্তিগত সাধ-আহ্লাদ, রূপ-রস-গন্ধ তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। জীবনের শুরু থেকেই নিজ এলাকার জনসাধারণকে বিভিন্নভাবে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার ছিলো এ-দেশের মানুষকে অত্যাচারী বেনিয়াদের হাত থেকে যেকোনো মূল্যে উদ্ধার করতে হবে। তাঁর জীবন দিয়ে তিনি দেশ উদ্ধারের মূল্য পরিশোধ করে গেছেন।

শহীদ আসাদ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯৪২ সালের ১০ জুন এবং শহীদ হয়েছেন ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি। দেশব্যাপী প্রতিবছর ২০ জানুয়ারি আসাদ দিবস পালিত হয়ে আসছে। তাঁকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবতে হবে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের। এ-প্রজন্মই আসাদকে নিয়ে যাবে আরো দূর ভবিষ্যতে। শহীদ আসাদ বেঁচে থাকবেন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়।


নূরুদ্দীন দরজী সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here