রবিবার, মে ১৯, ২০২৪
spot_imgspot_img
Homeইতিহাসের পথ ধরেশিবপুরের গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতা | পর্ব ৮

শিবপুরের গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতা | পর্ব ৮

স্থানীয় নানা শ্রেণির মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত বই ও দলিল ঘেঁটে যাচাই-বাছাইপূর্বক এসব তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। কারো দৃষ্টিতে কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে এবং সঠিক তথ্য দিতে পারলে বিচার-বিশ্লেষণের আলোকে সংশোধনে আপত্তি থাকবে না। লেখার কলেবর বৃহৎ হওয়ায় লেখাটি চলছে ধারাবাহিকভাবে।

সীমারবাগ
‘সীমার’ শব্দটি শুনতে কেমন জানি লাগে। সীমার শব্দের একটি অর্থ অভদ্র পাষণ্ড ব্যক্তি, যার কোনো দয়া-মায়া নেই। যেকোনো অনুচিত, দুরূহ ও ভয়ঙ্কর কাজ সীমারেরা করতে পারে। আমাদের শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নের সীমারবাগের নামকরণ হয়েছে তেমনি এক পাষণ্ড ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতায়। লোকমুখে শোনা যায়, প্রায় দুইশত বছর আগে কোনো-একটি জমি সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি হয়েছিলো। আর সেই জটিলতার মীমাংসার জন্যে এলাকায় একটি সালিশ আহূত হয়। সালিশে অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছিলেন। সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে মীমাংসার জন্যে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে তাদের বক্তব্য প্রদান করছিলেন। কিন্তু তাদেরই একজন হঠাৎ সকলের উপস্থিতিতে অশালীন কথা বলে অভদ্র ও অগ্রহণযোগ্য আচরণ করেন। সভায় তৎসময় উপস্থিত সকলে তার এহেন কর্মকাণ্ডে খুবই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে এবং সেই ব্যক্তিকে ‘সীমার’ বলে গালি দিতে থাকে। এদিকে যে-ব্যক্তিকে সীমার বলে গালি দেয়া হয়, সেই ব্যক্তি খুব অপমানিত ও অসম্মানিত বোধ করে। এমন অপমানে মনের দুঃখে লোকটি এলাকা ছেড়ে কোনো-এক নির্জন স্থানে গিয়ে বসতি স্থাপন করে। কিন্তু সে চলে গেলেও এবং অপছন্দের হলেও ‘সীমার’ নামটি রয়ে যায় এবং মানুষের মুখে মুখে ছড়াতে থাকে। একসময় সেই এলাকা ‘সীমারবাগ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। অবশ্য সীমার শব্দের অপর একটি অর্থ মর্যাদা বা মর্যাদাবান। অনেকের মতে, এলাকায় একসময় অত্যন্ত মর্যাদাবান মানুষের বসবাস ছিলো, যা থেকে সীমারবাগ হয়েছে। সীমারবাগের সীমারবাগ করমালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি শিক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে চলেছে।

কুমারটেক
মনে করা হয়, এই এলাকার টেকে একসময় বহু সংখ্যক কুমার সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস ছিলো। তারা কারুকার্যে বিশেষ পারদর্শী ছিলো এবং সুন্দর সুন্দর মাটির পাত্র তৈরি করে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছিলো। আর সেই সুখ্যাতির জন্যেই ক্রমান্বয়ে মানুষের মুখে মুখে টেকটির নাম হয়ে যায় ‘কুমারটেক’। এ-টেকে এখন অনেক মানুষের সুশৃঙ্খল বসবাস রয়েছে।

কান্দাপাড়া
বর্তমান কান্দাপাড়া গ্রামে সুপ্রাচীনকালে পালতোলা নৌকা চলা নদীর তটভূমি ছিলো। সম্ভবত নদীটি ছিলো ধলেশ্বরী নদীর শাখা নদী। ধীরে ধীরে নদীতে পলি পড়ে জমতে জমতে ভরাট হতে থাকে এবং একসময় বড়ো চরে পরিণত হয়। আবার পতিত চরের একটি এলাকা পলি জমতে জমতে কান্দায় পরিণত হয়। সম্ভবত ১৭৬০ সালের দিকে নবসৃষ্ট ওই কান্দায় মানুষ বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। দীর্ঘদিন কান্দায় ৯ টি বাড়ি ছিলো। বর্তমানে সেখানে একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রামের সৃষ্টি হয়েছে। সেই ‘কান্দা’ হতেই ‘কান্দাপাড়া’ গ্রাম। স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালে এ-গ্রামে কান্দাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি গড়ে তোলা হয়। শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিত্ব হাজী আ. বাতেন মোল্লার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও গ্রামবাসীর সহায়তায় নতুন স্বাধীনতা প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসে অনেক আশা-ভরসা নিয়ে বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়। প্রথমদিকে এটি টিনের চালা ও মূলির বেড়া সম্বলিত স্কুলগৃহ ছিলো। নিচু জমিতে হওয়ায় গৃহে অনেক সময়ই পানি জমে থাকতো। ১৯৭৬ সালে এক কালবৈশাখী ঝড়ে স্কুলগৃহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। কিন্তু অদম্য গ্রামবাসীদের সহয়তায় সংস্কার হয়ে কয়েকদিনেই পূর্ণতা লাভ করে। ১৯৮৬ সালে বিদ্যালয়টি সরকারি অনুমোদন পেয়ে একটি সরকারি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে নিবেদিতপ্রাণ রেহেনা আফরোজ জীবনের শেষঅবধি এ-বিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বিদ্যালয়ের ফলাফলও ভালো এবং অনেক কৃতি ছাত্র-ছাত্রী এখান থেকে বের হয়েছে।

জামগড়
জাম থেকে জামগড়। যতোটুকু জানা যায়, প্রায় শতাধিক বছর আগে বর্তমান জামগড় এলাকায় একটি সুদৃশ্য ও বড়ো জামগাছ ছিলো। জাম গাছটির আশেপাশে কোনো বাড়িঘর ছিলো না। গাছটির জাম নাকি খুব সুস্বাদু ছিলো এবং এজন্যে দূর-দূরান্তের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা জামের মজা পেয়ে, জামের লোভে, এখানে আসা-যাওয়া করতো। গাছের নিচে বসে খেয়ে কিছু কিছু আবার বাড়িতেও নিয়ে যেতো। এরই ধারাবাহিকতায় কিছু দুষ্টু ছেলে আরো নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে জাম খাওয়ার জন্যে খেলাচ্ছলে সেখানে অস্থায়ী ছোটো খেলার ঘর তৈরি করে ফেলেছিলো। আবার পাশের চারণভূমিতে চড়ানোর জন্যে কেউ কেউ তাদের গরু-ছাগলও নিয়ে আসতো। সেই উৎসুক ছেলেদের বানানো ঘর দেখে এখানে ঘরবাড়ি তৈরি করে অনেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের চিন্তা করতে লাগলো। এভাবে এই এলাকায় জনবসতি গড়ে ওঠতে লাগলো। একসময় জনবসতি বৃদ্ধি পেতে পেতে এবং জামগাছকে কেন্দ্র করে পূর্ণাঙ্গ গ্রামে পরিণত হয় জামগড়।


নূরুদ্দীন দরজী
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here