সোমবার, মে ২০, ২০২৪
spot_imgspot_img
Homeইতিহাসের পথ ধরেশিবপুরের গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতা | পর্ব ১০

শিবপুরের গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতা | পর্ব ১০

স্থানীয় নানা শ্রেণির মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত বই ও দলিল ঘেঁটে যাচাই-বাছাইপূর্বক এসব তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। কারো দৃষ্টিতে কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে এবং সঠিক তথ্য দিতে পারলে বিচার-বিশ্লেষণের আলোকে সংশোধনে আপত্তি থাকবে না। লেখার কলেবর বৃহৎ হওয়ায় লেখাটি চলছে ধারাবাহিকভাবে।

দরগারবন্দ
শিবপুর তথা নরসিংদীর বহুল পরিচিত চিনাদী বিলের অবস্থান দুলালপুর ইউনিয়নে। চিনাদী বিলের পশ্চিম পাশে দরগারবন্দ গ্রাম। গ্রামের একটি বড়ো মাঠের মাঝখানে একজন বুজুর্গ পীরের দরগাহ আছে। আর তা থেকেই গ্রামের নাম দরগারবন্দ হয়েছে বলে অনেকেই জানান। গ্রামের পূর্ব, দক্ষিণ ও উত্তরাংশে চিনাদী বিলের বিস্তৃতি রয়েছে। দরগারবন্দ গ্রামটি খুবই দৃষ্টিনন্দন। গ্রামের মাঝামাঝি আছে দরগারবন্দ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের জন্যে জমি দিয়েছেন উদার ও বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিত্ব মরহুম আবদুল আলী মুন্সি। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মরহুম আলাউদ্দিন পণ্ডিত, সিরাজউদ্দীন আহাম্মদ ও আবদুল আলী মুন্সির নাম স্মরণীয়। আবদুল আলী মুন্সি ও সিরাজউদ্দীন আহাম্মদ বিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিলেন। এ- বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠিত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ডা. লুৎফর রহমান খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মনিরুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত আরডিও বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. আমজাদ হোসেন অন্যতম।

আলীনগর
এলাকায় মনুষ্য বসতি গড়ে ওঠার একদম প্রারম্ভে আলী মোহাম্মদ নামে একজন ব্যক্তির আগমন ঘটেছিলো এখানে। পরে আলী মোহাম্মদকে অনুসরণ করে অনেকেই এই এলাকায় বসতি গড়ে তুলতে থাকে। আগত সবার মধ্যে আলী মোহাম্মদ অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও ভালো মানুষ ছিলেন। নতুন বসতি স্থাপিত হওয়ার পর মহল্লা বা পাড়ার একটি নামকরণ করা অত্যন্ত দরকার হয়ে পরে। এলাকাবাসী সকলে মিলিত হয়ে শ্রদ্ধেয় আলী মোহাম্মদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ও নামকরণের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে গ্রামের নামকরণ করে আলীনগর। শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে আলীনগর অতিশয় সুন্দর একটি গ্রাম। এ-গ্রামের পশ্চিম পাশের নদীর কূল ঘেঁষা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে পথিকের মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। শীতলক্ষ্যা নদীর কূল ঘেঁষা আলীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এলাকার শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৩৮ সালে। জমি দিয়েছেন মরহুম মোহাম্মদ গয়েছ আলী। দুই বন্ধু ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। তাঁরা হলেন আলীনগরের মোসলেম উদ্দিন ও মধ্যনগরের হাফিজ উদ্দিন খান। প্রথমে বিদ্যালয়টি মধ্যনগরে থাকলেও পরে আলীনগরে স্থানান্তরিত হয়। স্মরণীয় শিক্ষকগণের মধ্যে ছিলেন মরহুম আবদুল বাতেন। তিনি একবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বহু উচ্চ পদে কাজ করেছেন। এডভোকেট হাবিবুর রহমান এই স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন।

পাড়াতলা
পাড়াতলা শীতলক্ষ্যা নদীর একদম তীর ঘেঁষা একটি গ্রাম।  ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর কোথা থেকে একদল ইংরেজ এলাকায় এসেছিলো। এসেই বেনিয়ারা তাদের আধিপত্য স্থাপনের  জন্যে নদীর ঢালে পাড়া কুপে ঘাঁটি শক্ত করতে চায়। দিনের শেষে ইংরেজরা চলে গেলে এলাকাবাসী একত্র হয়ে রাতে সেই পাড়া নদীতে ভাসিয়ে দিতো। তখন নদী খুবই খরস্রোতা ছিলো। বেনিয়াদের তৈরি পাড়া কোথায় যে হারিয়ে যেতো, তার কোনো হদিসই মিলতো না। এভাবে ইংরেজরা পাড়া কুপতো আর জনগণ তা ভেঙে নদীতে ভাসিয়ে দিতো। এভাবে চলছিলো বহুদিন এবং এলাকাবাসীর সাথে ইংরেজ বেনিয়ারা পেরে ওঠেনি। পরবর্তীতে পরিশ্রান্ত এলাকাবাসী গ্রামের নামকরণ করেন ‘পাড়তলা’ এবং পরে ‘পাড়াতলা’। যার অর্থ তলিয়ে যাওয়া পাড়া। গ্রামের পাড়াতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯২৯ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ও জমিদাতা ছিলেন যথাক্রমে মরহুম বশিরউদ্দিন ভূঁইয়া, এবং মরহুম আবদুল কুদ্দুস পণ্ডিত। বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন জনাব হেলেনা বেগম ও মোহাম্মদ সামসুদ্দিন আহাম্মদ। কৃতী শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন অত্যন্ত মেধাবী মো. শফিকুর রহমান, যিনি সুপ্রতিষ্ঠিত কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। তাছাড়া বহু মেধাবী শিক্ষার্থী এ-স্কুলে পড়াশোনা করে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। পাড়াতলা শিকদার আবদুল মান্নান উচ্চ বিদ্যালয়টি সুদীর্ঘকাল যাবত গ্রামের ও পার্শ্ববর্তী এলাকার মাধ্যমিক শিক্ষার চাহিদা পূরণ করে আসছে। শিবপুরে এটি একটি উল্লেখযোগ্য উচ্চ বিদ্যালয়।

মধ্যনগর
আলীনগর ও পাড়াতলা গ্রামের ঠিক মধ্যিখানে মধ্যনগর গ্রাম। একসময় মধ্যপাড়া বলে মানুষ চিনতো। এরই মধ্যে কোনো-এক সৌন্দর্যপিয়াসী ভালোবেসে গ্রামের নামকরণ করে মধ্যনগর। মধ্যনগর নদীর কিনারায় অতিশয় সুন্দর একটি গ্রাম। আলীনগর ও মধ্যনগর এখন পাশাপাশি গ্রাম।

পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদী আর পূর্বে চিনাদী বিল উল্লিখিত গ্রামগুলোর সৌন্দর্য বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে। নদীর পশ্চিম পাড় ঘেঁষা গাজীপুর জেলার রাণীগঞ্জ, চাপাইর, তারাগঞ্জ পূর্ব পাড়ের সাথে মনে হয় গভীর মিতালি ও আত্মীয়তার সম্মিলন ঘটিয়েছে। অন্যদিকে চিনাদী বিলকে ঘিরে আছে রূপকথার রহস্যগাথা, শিহরণ জাগানো কাহিনি। সেই সাথে নিত্যদিন রয়েছে পর্যটকের ভিড়।


নূরুদ্দীন দরজী
সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here