তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে হাঁটি হাঁটি পা পা করে উঠেছিলেন রাজনীতির শীর্ষ চূড়ায়। শ্রমিক নেতা থেকে হয়েছিলেন চারবারের সংসদ সদস্য। রাজনৈতিক পরিচয় ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন নরসিংদীর গণমানুষের নেতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের আশার আশ্রয়স্থল।
চিরদিন তোমাকে ভালোবেসে যাবো, আমাকে দিবো না ভুলিতে।
২৭ মার্চ নরসিংদীবাসীর প্রিয় নেতা, প্রিয় মানুষ সামসুদ্দিন আহমেদ এছাক (সামসু)-র মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি প্রয়াত হয়েছেন প্রায় ১৮ বছর। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন তাঁর আপন সৃষ্টিকর্মের মধ্যে, তাঁর প্রতিষ্ঠিত আরশীনগরে, তাঁর লেখা গানে, নাটকে, কবিতায়।
তিনি তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে হাঁটি হাঁটি পা পা করে উঠেছিলেন রাজনীতির শীর্ষ চূড়ায়। শ্রমিক নেতা থেকে হয়েছিলেন চারবারের সংসদ সদস্য। রাজনৈতিক পরিচয় ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেছিলেন নরসিংদীর গণমানুষের নেতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষের আশার আশ্রয়স্থল। তিনি ছিলেন সমাজের শোষিত, নির্যাতিত, সর্বহারা মানুষের ভরসার প্রতীক। তারা তাঁকে তাদের শ্রেণির লোক মনে করতো। সামসুদ্দিন এছাক সাধারণ মানুষের মনের ভাষা বুঝতে পারতেন। তাই তাঁর লেখনীতে, রাজনীতিতে তিনি সবসময় তাদের কথা বলেছেন সাহসের সাথে। তিনি কখনো জটিল-কঠিন ভাষায় সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলতেন না, কঠিন-জটিল ভাষায় কোনো লেখা লিখতেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাধারণ-সহজ-সরল মানুষের আপনজন হতে হলে তাদের মতো করে চলাফেরা করতে হবে, তাদের মতো করে জীবনযাপন করতে হবে, তাদের ভাষায় কথা বলতে হবে। সারাজীবন ধরে তিনি তা-ই করে গেছেন।
তিনি দু’হাত ভরে নাটক, কবিতা, গান লিখেছেন। নিজের লেখা নাটকে নিজে অভিনয় করেছেন, নিজের লেখা গানে নিজে সুর করেছেন, নিজে কণ্ঠ দিয়েছেন, কবিতা লিখেছেন, আবার নিজে আবৃত্তি করেছেন। এমন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রাজনীতিবিদ নরসিংদী কেন, সারা বাংলাদেশে হাতে গোনা। একজন ক্ষুদে নাট্যকর্মী হিসেবে আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর নিজের হাতে গড়া নরসিংদীর প্রথম গ্রুপ থিয়েটার সংগঠন ‘নরসিংদী থিয়েটার’-এর হয়ে তাঁর সাথে কাজ করার। তাঁর সাথে কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি, তিনি কতো বড়ো মাপের মানুষ ছিলেন। আজকে যে নরসিংদী পৌরসভা হলো, এটা তাঁর কৃতিত্ব।
তখন তিনি নরসিংদী পৌরসভার চেয়ারম্যান, পৌরসভার অডিটোরিয়াম করার মতো টাকা ছিলো না। তিনি নিজে বাজার থেকে চাঁদা তুলে এই পৌর মিলনায়তন নির্মাণ করেন। নরসিংদীর শিল্প-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র ছিলো তখন পৌর অডিটোরিয়াম। তখন নরসিংদীতে শিল্প-সংস্কৃতির জোয়ার ছিলো। বিভিন্ন নাট্যদলের অনেক ভালো ভালো নাটক এখানে মঞ্চায়িত হয়েছে। তাঁর লেখা ‘পাষাণের কান্না’, ‘বিকৃত সমাজ’, ‘আরো একটা যুদ্ধ চাই’ নাটকে তিনি নিজে অভিনয় করেছেন। ‘শেষ উপহার’ সিনেমায় তাঁর লেখা ও সুর করা ‘চিরদিন তোমাকে ভালোবেসে যাবো, আমাকে দিবো না ভুলিতে’ গানটি সারা বাংলাদেশে তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। শুধু এই গানটির কারণে ছবিটিও সুপারহিট হয়েছিলো।
রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় থাকলে কোটি কোটি টাকা ব্যাংক-ব্যালেন্স করে, বাড়ি-গাড়ি করে। তিনি সেসবের পেছনে না ছুটে রেল থেকে জমি লিজ নিয়ে নরসিংদী শহরে গড়ে তোলেন প্রথম বিনোদন পার্ক ‘আরশীনগর’। পার্কে ছিলো অনেক রকমের ফুল-ফলের গাছ, নানা জাতের পশুপাখি, মাছ, জীবজন্তু। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আরশীনগরে আধ্যাত্মিক গানের জলসা বসতো। তিনি এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শিল্পীরা এসে এখানে গান করতো। তিনি নিজ হাতে রান্না করে তাদের খিচুড়ি খাওয়াতেন। বৈশাখ এলে প্রতি বছর আরশীনগরে সপ্তাহব্যাপী মেলা বসতো। ব্যবসায়ীরা গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসতো। নাগরদোলা, পুতুলনাচ, মাটির আসবাবপত্র, খেলনা, বই— কতোকিছুর আয়োজন থাকতো মেলায়। নরসিংদীর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন নাচ-গান, কবিতা, নাটক নিয়ে মেলায় হাজির থাকতো।
সামসুদ্দিন এছাক একজন স্বপ্নচারী মানুষ ছিলেন। নিজে স্বপ্ন দেখতেন, অন্যকে স্বপ্ন দেখাতেন। তিনি সারা জীবন সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে চিন্তা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে হবে, মানবিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং এজন্যে দরকার শুদ্ধ-সুন্দর সংস্কৃতির চর্চা। সংস্কৃতিচর্চাই পারে মানুষকে মানবিক সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে, সুন্দর ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। বর্তমান সময়ে যার অভাব অত্যন্ত প্রকট। সামসুদ্দিন আহমেদরা প্রতিদিন জন্মায় না, একবারই জন্মায়। আর একজন্মই তাঁদের আজীবন বাঁচিয়ে রাখে।
২৭ মার্চ এই গুণী মানুষটির মৃত্যু দিবস, আবার বিশ্ব নাট্য দিবসও। নাটকের মানুষ হিসেবে এই দিনটি আমাদের কাছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। তাই প্রার্থনা করি, সামসু ভাই আমাদের শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় ওপারে ভালো থাকুন।
শাহ্ আলম
নাট্যকর্মী
সাধারণ সম্পাদক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, নরসিংদী