১৯৫৪ সালে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার বছরই দৈনিক ‘সংবাদ’-এর মালিকানা পরিবর্তন হয়। এর মালিক হয়ে যান খায়রুল কবিরের ছোটো ভাই আহমেদুল কবির মনু মিঞা। সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন জহুর আহমেদ চৌধুরী। একই সময় ‘সংবাদ’-এ যোগ দেন দেশবরেণ্য সাংবাদিক রণেশ দাশ গুপ্ত, সত্যেন সেন, তোয়াব খান, কামাল লোহানী, মোহাম্মদ ফরহাদ ও বজলুর রহমান প্রমুখ। স্বাধীনতা যুদ্ধে পত্রিকার অফিস ও প্রেস আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি ‘সংবাদ’-এর পুনর্মুদ্রণ শুরু হলে সম্পাদনার দায়িত্ব নেন আহমেদুল কবির।
ঘোড়াশালের ঐতিহ্যবাহী মিঞা বাড়ির কৃতী পুরুষ খায়রুল কবির দৈনিক ‘সংবাদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যতোটা না পরিচিত, এরচেয়ে বেশি আলোচিত জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠাতা নয়, বর্তমান প্লটটি প্রেস ক্লাবের নামে বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে খায়রুল কবিরের অবদান ছিলো সবচেয়ে বেশি। তিনি এই ক্ষেত্রে এগিয়ে না এলে হয়তো এতো বড়ো একটি প্লট প্রেস ক্লাবের নিজস্ব সম্পত্তি হতো না।
একসময় এই প্লটের দোতলা একটি পুরোনো ভবনে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন বসু বাস করতেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। তাঁকে বসবাস করার জন্যে বরাদ্দ দেয়া হয় রমনা গ্রিনের অন্তর্ভুক্ত আবাসিক প্লটটি। সত্যেন বসু পুনরায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেলে প্লটটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে। পাকিস্তান আমলে গণপূর্ত বিভাগের অধীনে চলে যায়। সেখান থেকেই প্লটটি জাতীয় প্রেস ক্লাব বরাবর হস্তান্তর করে গণপূর্ত বিভাগ। প্রেস ক্লাবের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত খায়রুল কবির আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে জয় করে প্লটটি সাংবাদিকদের জন্যে বরাদ্দ করতে অনেক শ্রম দিয়েছিলেন। মন্ত্রী, আমলা আর শিল্পপতিদের শ্যেনদৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছিলেন প্রেস ক্লাবের সম্পত্তিটি।
শিল্পপতি এবং ব্যাংকার হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি। তাঁর সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয় ১৯৫১ সালে। সেই বছর ১৭ মে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে ইস্ট পাকিস্তান প্রেস, ২৬৩ নম্বর বংশাল রোড, পুরান ঢাকা থেকে ‘সংবাদ’ প্রকাশ করেছিলেন। তখন ৬ পৃষ্ঠার ‘সংবাদ’-এর মূল্য ছিলো ২ আনা।
পূর্ব পাকিস্তান প্রগতিশীল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার জন্যে পাকিস্তানি শাসকেরা ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ‘সংবাদ’ পত্রিকার প্রেস ও অফিস আগুনে পুড়িয়ে দেয়। সেই অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন সাংবাদিক সাবের। খায়রুল কবির ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচির অন্যতম রূপকার ছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ও ড. মাহমুদ হোসেন ও কাজী আনোয়ার হকের মতো বহু কৃতী ব্যক্তিত্বের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তিনি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা গঠন করলে এর প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োজিত হন খায়রুল কবির। একই সঙ্গে ইউনিয়ন ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনাইটেড ব্যাংক অব পাকিস্তানের ভাইস চেয়ারম্যান, পাকিস্তান শিল্প ব্যাংকের পরিচালক, জনতা ব্যাংকের প্রথম চেয়ারম্যান এবং আমেরিকান ব্যাংকার্স এসোসিয়েশনের ফেলো হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। তাছাড়া তিনি পূবালী জুট মিলস, ইস্ট পাকিস্তান কো-অপারেটিভ ইন্সুরেন্স সোসাইটির পরিচালক ছিলেন। ১৯৯৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
১৯৫৪ সালে ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠার বছরই দৈনিক ‘সংবাদ’-এর মালিকানা পরিবর্তন হয়। এর মালিক হয়ে যান খায়রুল কবিরের ছোটো ভাই আহমেদুল কবির মনু মিঞা। সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন জহুর আহমেদ চৌধুরী। একই সময় ‘সংবাদ’-এ যোগ দেন দেশবরেণ্য সাংবাদিক রণেশ দাশ গুপ্ত, সত্যেন সেন, তোয়াব খান, কামাল লোহানী, মোহাম্মদ ফরহাদ ও বজলুর রহমান প্রমুখ। স্বাধীনতা যুদ্ধে পত্রিকার অফিস ও প্রেস আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ৯ জানুয়ারি ‘সংবাদ’-এর পুনর্মুদ্রণ শুরু হলে সম্পাদনার দায়িত্ব নেন আহমেদুল কবির। তিনি ঘোড়াশাল মিঞা বাড়িতে ১৯২৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। জমিদার আবু ইউসুফ লুৎফুল কবির ছিলেন তাঁর বাবা। আহমেদুল কবির ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)-র প্রথম নির্বাচিত ভিপি। তিনি বড়ো ভাই খায়রুল কবিরের পথ ধরে একজন ব্যাংকার হিসেবেও সফল ছিলেন। প্রথমে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’য় যোগ দেন। এরপর ইস্ট পাকিস্তান ফরেন এক্সচেঞ্জের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৫০ সালে তিনি পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। ১৯৫৪ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তান ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক এবং বাংলাদেশ আইএফআইসি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালকের দায়িত্ব নেন। একই সঙ্গে তিনি এসেন্সিয়াল ইন্ডাস্ট্রিজ, ভিটা কোলা, বেঙ্গল বেভারেজ ও ঢাকা ওয়্যার হাউজের মতো প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন।
তিনি মোজ্জাফফর ন্যাপের একজন সক্রিয় নেতা হিসেবে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৯ ও ১৯৮৬ সালে নরসিংদী-২ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর মার্কা ছিলো হুক্কা। ১৯৯০ সালে তিনি গণতন্ত্রী পার্টি গঠন করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষক আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। কৃষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৩ সালের ২৪ নভেম্বর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি ছিলেন।
মিঞা বাড়ির সাংবাদিকতায় আলতামাশ কবির নতুন নক্ষত্র। তিনি বাবা আহমেদুল কবিরের ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। বাবার মৃত্যুর পর ঐতিহ্যবাহী ‘সংবাদ’ অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। একাধিকবার পত্রিকাটি বিক্রি হওয়ার গুজব ওঠে। কিন্তু বাবার অত্যন্ত প্রিয় ‘সংবাদ’ পত্রিকাটি বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে আসেন আলতামাশ কবির। তিনি ‘সংবাদ’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করে নতুনভাবে বিনিয়োগ করেন। তিনি লন্ডনস্থ স্কুল অব ইকোনমিক্স এন্ড পলিটিক্যাল সাইন্সে গ্র্যাজুয়েট ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স এন্ড পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যালামনাই এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর বর্তমান সভাপতি। বাবার প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একই সঙ্গে কেদারপুর টি কোম্পানি ও সাতগাঁও টি এস্টেটের মালিকানা রয়েছে তাঁর। তিনি ২০১৮ সালে প্রেস কাউন্সিল পদক লাভ করেন ‘সংবাদ’-এ আপোষহীন ও নির্ভীক সাংবাদিকতার জন্যে। একই সঙ্গে ২০০৯-১২ পর্যন্ত বাসসের পরিচালক, ২০০৯-১০ ও ২০১২-১৩ পর্যন্ত প্রেস কাউন্সিলের বোর্ড সদস্য এবং ২০১৬ ও ২০১৭ সালে প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের ট্রাস্টির দায়িত্ব পালন করেছেন। সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার্স ওনার্স এসোসিয়েশনের (নোয়ার) দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সম্পাদনা ছাড়াও ক্রীড়া ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। ক্লে টার্গেট শ্যুটিংয়ে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন ছিলেন তিনি, পাশাপাশি সাফ গেমস, কমনওয়েলথ শ্যুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়ান শ্যুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপসহ আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
বাবার প্রতিষ্ঠিত ‘সংবাদ’ পত্রিকার সঙ্গে জড়িত আছেন তাঁর মেয়ে ব্যারিস্টার নিহাদ কবির। তিনি সংবাদ পরিচালক এবং শেয়ার হোল্ডার হিসেবে ভাই আলতামাশ কবিরকে সহযোগিতা করছেন। ‘সংবাদ’ ছাড়াও তিনি ব্র্যাক ব্যাংক আইডিসিওএল (ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড), পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন, বিকাশ, স্কয়ার ফার্মা ও এপেক্স ফুটওয়্যারের পরিচালক। তাছাড়া তিনি ব্র্যাক ইপিএল স্টক ব্রোকারেন্স ও ব্র্যাক ইপিএল ইনভেস্ট মেন্টর্সের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। একাধারে ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। কেদারপুর ও সাতগাঁও চা বাগান তাঁদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। আহমেদুল কবিরের স্ত্রী লায়লা কবির বাংলাদেশ চা শিল্পের কিংবদন্তী নারী। তিনি বাংলাদেশ চা সংসদের প্রথম নারী সভাপতি। লায়লা কবির ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বারেরও প্রথম নারী সভাপতি ছিলেন। তাঁদের ছোটো ছেলে আরদাশীর কবিরও ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেছেন।
ভারতের জলপাইগুড়িতে জমিদার কন্যা লায়লা কবির পারিবারিক সূত্রে একাধিক চা বাগানের মালিক ছিলেন। ঘোড়াশাল মিঞা বাড়ির আহমেদুল কবিরের সাথে বিয়ের পর সেসব চা বাগানের পাশাপাশি আরো অনেক শিল্প কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের এমডি, চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন এ-বর্ষীয়ান মহিয়সী নারী। স্বামীর অবর্তমানে তিনিও ‘সংবাদ’ পরিবারের অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করছেন।
আপেল মাহমুদ সাংবাদিক, গবেষক ও দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ সংগ্রাহক