বুধবার, মে ১৫, ২০২৪
spot_imgspot_img
Homeইতিহাসের পথ ধরেশিবপুরের গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতা | পর্ব ৭

শিবপুরের গ্রাম ও গ্রামীণ সভ্যতা | পর্ব ৭

স্থানীয় নানা শ্রেণির মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে ঐতিহাসিক তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত বই ও দলিল ঘেঁটে যাচাই-বাছাইপূর্বক এসব তথ্যাদি সংগ্রহ করা হয়েছে। কারো দৃষ্টিতে কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে এবং সঠিক তথ্য দিতে পারলে বিচার-বিশ্লেষণের আলোকে সংশোধনে আপত্তি থাকবে না। লেখার কলেবর বৃহৎ হওয়ায় লেখাটি চলছে ধারাবাহিকভাবে।

অষ্টয়ানী জয়নগর
বৃহত্তম জয়নগর গ্রামেরই একটি অংশ অষ্টয়ানী জয়নগর। অষ্টয়ানী অর্থ মোটামুটি আট আনা। ৪০-৫০ বছর আগে ষোলো আনায় হতো এক টাকা, যেখানে বর্তমানে ১০০ পয়সায় এক টাকা। তখন আট আনায় অনেক কিছু কেনা যেতো, যা বর্তমানে শত টাকা দিয়েও কেনা যায় না। সে যাই হোক, আট আনা দিয়ে এক টাকার অর্ধেক বোঝায়। আমরা ইতোপূর্বে জেনেছি, জয়নগর গ্রামের নামকরণ কীভাবে হয়েছে। যেকোনো প্রতিযোগিতায় ওই গ্রামের বিজয় ছিনিয়ে আনাই ছিলো গ্রামবাসীর একমাত্র কাজ। বিজয় ছাড়া তারা কিছুই বুঝতে চাইতো না। জয়নগর যে-বিজয় অর্জন করতো, গ্রামের একটি নির্দিষ্ট এলাকার মানুষ তার অর্ধেকের দাবিদার ছিলো। বর্তমানে যে-এলাকা অষ্টয়ানী জয়নগর হিসেবে পরিচিত, এই এলাকার মানুষ পুরো গ্রামের অর্ধেক বিজয় অর্জন করতো। গ্রামে যে-বিজয় উৎসব হতো, তার অর্ধেক হতো অষ্টয়ানীতে। আর এজন্যেই এলাকাটি অষ্টয়ানী নাম নিয়ে গর্বে বুক বেঁধে আছে, অর্থাৎ গ্রামের নাম অষ্টয়ানী। এ-গ্রামের অষ্টয়ানী জয়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৩৫ সালে। বিদ্যালয়টি একসময় মৌলভীবাড়ি বিদ্যালয় নামে পরিচিত ছিলো। তবে মৌলভীবাড়িতে পর্যাপ্ত জমি না থাকায় সুহৃদ ডেঙ্গু ভূঁইয়া এবং মফিজউদ্দিন ভূঁইয়া অন্যত্র জমি দেয়ার ব্যবস্থা করেন। উল্লেখিত মহান ব্যক্তিদ্বয় জমির ব্যবস্থা করার পর মৌলভীবাড়ির নাম পরিবর্তন হয়ে নতুন নামকরণ করা হয় অষ্টয়ানী জয়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর সহচর সামসুদ্দিন ভূঁইয়া বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, যিনি অষ্টয়ানী জয়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েই ছাত্র। শিবপুরের বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, শিক্ষানুরাগী ও শ্রদ্ধাভাজন মরহুম আফছার উদ্দিন ভূঁইয়া এ-গ্রামের সন্তান। কৃষি বিভাগের পরিচালক মো. সফিউদ্দিন ভূঁইয়া, আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন জনাব গাজী গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, উত্তরা ব্যাংকের এমডি বাহাউদ্দিন ভূঁইয়া, এডভোকেট জামালউদ্দিন, মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা’র অধ্যাপিকা ডা. ফাতেমা বেগম (অব.), জয়নগর ডিগ্রি কলেজের প্রিন্সিপাল মো. জামালউদ্দিন ভূঁইয়া, বিশিষ্ট পরিচালক জনাব আবদুল আউয়াল, শিল্পপতি গোলাম মাহমুদ ভূঁইয়া ঐতিহ্যবাহী অষ্টয়ানী জয়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী।

ধুপিরটেক
জয়নগর ইউনিয়নে ধুপিরটেক গ্রামটি খুবই পুরাতন। এ-গ্রামের নামকরণ নিয়ে কিছুটা মতভেদ আছে। মূলত এটি একটি পুরাতন টেক। অনেকের মতে, এই টেকে একসময় প্রচুর পরিমাণে ঢুপি পাখির আনাগোনা ছিলো। ঢুপি একপ্রকার পাখি, অন্য পাখি শিকারে এ-পাখির সহায়তা দরকার হয়। আরো বলা যায়, এটি শিকারি পাখি। শিকারিরা জাল পেতে এই পাখিকে জালে আটকে রাখে, যেন অন্য পাখি এদের ডাকাডাকি শুনে তাদের কাছে এসে জালে ধরা পড়ে। একেক এলাকায় এদের নাম একেক রকম হতে পারে, কিন্তু শিবপুর এলাকায় এদের ঢুপি পাখি বলা হয়। এই ঢুপি পাখির টেকে বেশি বেশি আনাগোনাকে ভিত্তি করেই গ্রামের নাম হয় ঢুপিরটেক, যা পরবর্তীতে পরিবর্তন হয়ে বর্তমানের ধুপিরটেক হয়েছে। আবার এমনও মনে করা হয় যে, প্রায় ৫০০ শতাধিক বছরেরও আগে এখানকার সামান্য সংখ্যক লোক কাপড় ধোয়ার কাজ করতেন। আর সেই থেকে এই টেককে বলা হতো ধুপিরটেক। তবে এমন হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন না। ধুপিরটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক জনাব মো. সিরাজুল ইসলাম জানান যে, আমাদের গ্রামে এমন ছিলো বলে মনে হয় না এবং এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত আমার জানা নেই। সে যাই হোক, ধুপিরটেক বর্তমানে খুবই প্রসিদ্ধ গ্রাম। এখানে রয়েছে শত শত বছর (কারো মতে হাজার বছর) পুরোনো একটি ‘বুদ্ধ পদ্ম মন্দির’। ধুপিরটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আঙিনার পূর্বপাশে এ-মন্দিরটির অবস্থান। এই এলাকায় এখন আর বৌদ্ধদের বসবাস না থাকায় দীর্ঘদিন মন্দির অযত্নে ও অবহেলায় ছিলো। সবশেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল প্রত্নতাত্ত্বিক মন্দিরটি সংস্কার করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। এখন মন্দিরের অবস্থান সুদৃশ্যমান। ধুপিরটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭২ সালে, আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের অব্যবহিত পর। বিদ্যালয়ের জন্যে জমি দিয়েছেন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ইসমাইল ক্বারী। এলাকার শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে এ-বিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে।

মৈষারটেক
আবারো টেকেরই কথা। শিবপুর এলাকায় প্রচুর টেক বা টিলা আছে, কথাটি আগেও বলা হয়েছে। এমনি আরো একটি টেক মৈষারটেক। এলাকায় একসময় অনেক বেশি নিরীহ প্রাণি মহিষ পালন করা হতো বলে মনে করা হয়। অনেক উঁচু এই টেকে মহিষ থাকতো প্রচুর এবং এ-কারণে টেকের নাম হয় মহিষটেক। পরবর্তীতে এখানে মানুষের বসবাস গড়ে ওঠলে গ্রামের সুন্দর নামকরণ হয়ে যায় মৈষারটেক। তখন এলাকার যারা মহিষ পালন করতো, তাদের মৈষান বলা হতো। অবশ্য তারা এখন আর নেই। এলাকায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৭৩ সালে। এ-বিদ্যালয়ের জন্যে জমি দিয়েছেন মহৎপ্রাণ মমতাজ উদ্দিন ও মতিউর রহমান। অনেক অনেক সুযোগ্য শিক্ষকগণের মধ্যে এ-বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু যতীন্দ্র চন্দ্র রায়। তিনি ছিলেন সুশিক্ষক। তিনি ইংরেজিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। আমাদের দেশে দীর্ঘকাল ইংরেজ শাসন-শোষণ জবরদস্তিমূলকভাবে চালু ছিলো। ইংরেজি না জানার কারণে এ-দেশের মানুষ অনেক পিছিয়ে পড়েছিলো। এটিই ছিলো যতীন্দ্র বাবুর সবচেয়ে বড়ো কষ্ট। ইংরেজিতে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীসহ সকলকে এগিয়ে নিতে তিনি প্রায় সময়ই ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতেন। ইংরেজি শেখাতে চেষ্টা করতেন। একজন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এমনভাবে ইংরেজি বলেন, এমনটি সচরাচর দেখা যায় না। আমার লেখার সময় যতোটা জানি, তিনি শিক্ষকতা হতে অবসর গ্রহণ করেছেন। তাঁকে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক অনেক দিন স্মরণ রাখবে। স্মরণ রাখবেন তাঁর সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব, তাঁর অফিস ও শিবপুরের মানুষ।


নূরুদ্দীন দরজী সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here