বুধবার, মে ১৫, ২০২৪
spot_imgspot_img
Homeপ্রগতির পদাতিকবিনোদ বিহারী সাহা : আলোকিত বর্ষীয়ান এক বটবৃক্ষ

বিনোদ বিহারী সাহা : আলোকিত বর্ষীয়ান এক বটবৃক্ষ

অবসরে বই-পত্রিকা পড়ার ফাঁকে এখন মৃত্যুকেই বেশি মনে পড়ে। বাঁচার আগ্রহ নেই, জীবনকে সুদীর্ঘকাল উপভোগ করেছি। একটি নতুন গাড়ি পুরাতন হলে যা হয়, এখন জীবনটা এভাবেই চলছে। আমি মনে করি, গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়া মাত্র।

বিনোদ বিহারী সাহা একজন প্রবীণ সমাজহিতৈষী ব্যক্তিত্ব। সমাজে নানা মাত্রার আলো ছড়ানো মানুষ। অত্যন্ত সজ্জন, বিনয়ী ও আদর্শিক মানুষ। নরসিংদীর সব বয়সী ও শ্রেণি-পেশার অনেকেরই নমস্যজন তিনি। তাঁর হাত দিয়ে জ্বলে ওঠেছে অসংখ্য প্রদীপ। দীপ্তিমান আলো ছড়াচ্ছেন স্বমহিমায়। নরসিংদী ডায়াবেটিস হাসপাতাল, নরসিংদী সরকারি মহিলা কলেজ, নরসিংদী উচ্চ বালিকা বিদ্যানিকেতন, শিউলিবাগ বিদ্যাপীঠের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। শিউলিবাগ বিদ্যাপীঠের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বর্তমান সভাপতি।

বয়স ৯১ বছর। স্মৃতিবিভ্রমসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন তিনি। বিনোদ বিহারী সাহা বর্তমানে নরসিংদী পৌরসভার ১১১, মধ্য কান্দাপাড়ার বাসায় অনেকটা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করছেন। সোনালি দিনের মানুষগুলো আজ অনেক অচেনা, বন্ধুমহলে গল্পবিলাসী মানুষ হিসেবে পরিচিত বিনোদ বিহারী সাহার আজ একমাত্র গল্পের সাথী সহযোদ্ধা ও স্ত্রী কল্পনা রাণী সাহা। ১৯৬০ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন তাঁরা। বিনোদ বিহারী সাহার চার কন্যা— সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে সংসারী হয়েছেন। বড়ো, মেজো ও সেজো কন্যার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার। ছোটো মেয়ের স্বামী ডাক্তার। তাঁর নাতি-নাতনিরাও উচ্চশিক্ষিত। অনেকেই পিএইচডি অর্জন করেছেন। তাই নিজের আর কোনো আক্ষেপ নেই বলে বিনোদ বিহারী সাহা নিজেকে সফল ও সার্থক মানুষ হিসেবে দাবি করেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি এই সমাজের একজন সফল ও সার্থক মানুষ। তবে এই পর্যায়ে আসতে তাঁকে অনেক কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছে। পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক কষ্টের আর দুর্গম পথ।

তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালে, কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার দিঘলদী গ্রামে। পিতা মহীম চন্দ্র সাহা ও মাতা প্রেমদা সুন্দরী। চার ভাই আর এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। খুব ছোটোবেলায় মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছেন। ৮ বছর বয়সে মা, ১০ বছর বয়সে বাবাকে হারান। ১২ বছর বয়সে হারান বড়ো ভাই এবং হারান ছোটো ভাইটিকেও। তাঁর নানা মুরাদনগর উপজেলার গাঙ্গের কোট গ্রামে তাঁকে নিয়ে যান। সেখানেই তিনি পড়াশোনা করতে থাকেন। ১৯৫২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অকৃতকার্য হন। পরে জীবন-জীবিকার তাগিদে মামাদের হাত ধরে নরসিংদীর শেখেরচরে ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫৫ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে নরসিংদীতে বসবাস শুরু করেন।

নানা বিষয় নিয়ে তাঁর সাথে কথা হয়। তিনি জানান, বই এবং পত্রিকা পড়া তাঁর শখ। রাজনীতি সচেতন মানুষ হিসেবে তিনি মনে করেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন আদর্শিক নেতা। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বও সঠিক পথেই আছে বলে মনে করেন তিনি। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, “আমাদের সময় পড়াশোনা আর এখনকার পড়াশোনায় অনেক পার্থক্য। এখন প্রাইভেট আর কোচিং নির্ভর পড়াশোনা। অনেক শিক্ষকও আদর্শচ্যুত।”

তিনি ৫২-র ভাষা আন্দোলনের মিছিলে ছিলেন তিনি। মহান একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় দীর্ঘদিন গুরুতর অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী ছিলেন। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে না পারার আক্ষেপও রয়েছে তাঁর।

তাঁর ভাষায়, “অবসরে বই-পত্রিকা পড়ার ফাঁকে এখন মৃত্যুকেই বেশি মনে পড়ে। বাঁচার আগ্রহ নেই, জীবনকে সুদীর্ঘকাল উপভোগ করেছি। একটি নতুন গাড়ি পুরাতন হলে যা হয়, এখন জীবনটা এভাবেই চলছে। আমি মনে করি, গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়া মাত্র।”

বাসায় অনেকগুলো সম্মাননা ক্রেস্ট ও উত্তরীয় দেখে প্রশ্ন করি, “শিক্ষা-চিকিৎসাসহ সামাজিক ক্ষেত্রে এতো অবদানের স্বীকৃতি সম্পর্কে কিছু বলবেন?” তিনি বলেন, “এগুলো অপাত্রে কন্যাদানের মতো। যারা দিয়েছেন, তারা অন্যায় করেছেন, আমার চেয়ে অনেক যোগ্য, গুণী মানুষ এ-সমাজে রয়েছেন, তাঁদের সম্মানিত করা উচিত।”

সবশেষে তিনি সকলের আশীর্বাদ কামনা করেছেন।


মোতাহার হোসেন অনিক প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, নবধারা প্রি-স্কুল

সম্পর্কিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here