সোমবার, এপ্রিল ২৯, ২০২৪
spot_imgspot_img
Homeইতিহাসের পথ ধরেনরসিংদী সরকারি কলেজের ৭৩ বছর : গোড়াপত্তনের সার্বিক পাঠ

নরসিংদী সরকারি কলেজের ৭৩ বছর : গোড়াপত্তনের সার্বিক পাঠ

এদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রাথমিক কথা
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। অন্যান্য প্রাণীর ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব এসেছে তার জ্ঞানের শক্তির জন্যে। মানুষ জ্ঞানের এই শক্তি অর্জন করেছে পারিপার্শ্বিক জীবন ও জগত থেকে; জীবন ও জগতকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে। জীবন ও জগতকে পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে মানুষ যা অর্জন করেছে, তা-ই তো শিক্ষা। শিক্ষাই মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে টেনে এনেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই বলেছেন, “আলোতে মানুষ মেলে অন্ধকারে মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়।” অন্ধকার হতে আলোতে আসার জন্যে সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ অনুকরণ, অনুসরণ, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেই শিক্ষা লাভ করতো। সভ্যতার বিকাশের ক্রমধারায় পরবর্তীতে শিক্ষালয় গড়ে ওঠেছে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান নামে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। নতুন দুই রাষ্ট্রেই স্বাধীন দেশের উপযোগী নতুন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবি ওঠে এবং দেশের প্রয়োজনেই নতুন নতুন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠতে থাকে। এই সময়কালে নরসিংদীতে কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়ে যায় এবং দেশভাগের পরপরই নরসিংদীতে কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু হয়।

নরসিংদী কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক কথা
কলেজ পর্যায়ে নরসিংদী অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিলো দেশভাগের পূর্বেই। এ-অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী মাধ্যমিক স্কুলগুলো তার উদাহরণ। ১৯০১ সালে সাটিরপাড়া কালী কুমার, ১৯০৫-০৬ সালে বালাপুর ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯১২ সালে আদিয়াবাদ ইসলামী উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯১৯ সালে স্যার কে. জি. গুপ্ত উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯৩৮ সালে নরসিংদী উচ্চ বিদ্যালয় (গান্ধী স্কুল), ১৯৪৬ সালে ব্রাহ্মন্দী কে. কে. উচ্চ বিদ্যালয় এবং মাধবদী এস. পি. ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মাধ্যমিক পরবর্তী উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার পথ উন্মুক্ত হয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়া এবং নরসিংদী অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে যাঁদের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়, তাঁরা হলেন নরসিংদীর জমিদার মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্ব ললিত কুমার রায়, নরসিংদীর কৃতী সন্তান সুন্দর আলী গান্ধী, ব্রাহ্মন্দীর জমিদার জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিক, বালাপুরের খ্যাতনামা জমিদার নবীন চন্দ্র, ভাটাপাড়ার স্যার কে. জি. গুপ্ত, জমিদার নগেশ চন্দ্র গুপ্ত এবং নরসিংদীর গৌরব ভাই গিরিশচন্দ্র সেন, কবিয়াল হরিচরণ আচার্য্য।

এ-এলাকায় শিক্ষা বিস্তারে উপরে উল্লিখিত ব্যক্তিদের অবদান স্মরণ না করলে ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করা হবে। তৎকালীন সময়ে নরসিংদীর অগ্নিপুরুষ সুন্দর আলী গান্ধী, জমিদার ললিত মোহন রায় এবং অন্যান্য স্বদেশী বিপ্লবীদের আকাঙ্ক্ষা এবং অনুপ্রেরণায় ১৯২১ সালে নরসিংদীতে একটি জাতীয় কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। এই কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শিক্ষাবিদ ড. সতীশ চন্দ্র দাশগুপ্ত। সুন্দর আলী গান্ধীর আমন্ত্রণে ভারতবর্ষের খ্যাত বিপ্লবী সতীশচন্দ্র পাকড়াশী ১৯২২ সালে নরসিংদী জাতীয় কলেজে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে কলেজটি বন্ধ হয়ে গেলেও এই এলাকায় উচ্চশিক্ষার একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে যায়।

নরসিংদী সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়টি আজকে যেখানে অবস্থান করছে, তার পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকালে জানা যাবে, এই স্কুল-স্থলটি ছিলো জমিদার ললিত কুমার রায়ের সন্তানদের দ্বারা নির্মিত চিনি উৎপাদনের কারখানা। পরবর্তী সময়ে এ-অঞ্চলে নারী শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে জমিদার মাতা কমলকামিনী’র নামে পরিত্যক্ত চিনিকল-স্থানে গড়ে ওঠে ‘কমলকামিনী গার্লস স্কুল’। বালিকা বিদ্যালয়টি বেশিদিন চালু রাখা যায়নি। দেশভাগের পর বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। কারণ হিসেবে জানা যায়, বিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষক এবং ছাত্রী ছিলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী। দেশভাগে অনেক ছাত্রী এবং শিক্ষক ভারতে চলে যায় এবং তখন মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষা বিস্তারে বাধা ছিলো অনেক। একপর্যায়ে বিদ্যালয় পরিচালনার জন্যে দায়িত্বশীল শিক্ষানুরাগী এবং ছাত্রী-শিক্ষকের অভাবের কারণেই বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়ে যায়। এ-পরিত্যক্ত বালিকা বিদ্যালয়ের জায়গাজমি এবং ঘরে গড়ে ওঠে বৃহত্তর নরসিংদী অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ নরসিংদী কলেজ।

কলেজ গড়ার প্রথম ও পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সভা
১৯৪৯ সালের ২২ এপ্রিল, নরসিংদীর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ এবং মুহূর্ত। নরসিংদী তখন নারায়ণগঞ্জ মহকুমার প্রশাসনিক কাঠামোর আওতাভুক্ত। নরসিংদীর শিক্ষানুরাগী মহৎপ্রাণ ব্যক্তিবর্গ, সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে উক্ত তারিখে এক জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় একটি সিনেমা হলে। আলোচনার বিষয়বস্তু নরসিংদী অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত করার জন্যে কীভাবে এ-অঞ্চলে একটি কলেজ গড়ে তোলা যায়। জনসমাবেশের সভাপতির আসন অলংকৃত করেন তৎকালীন নরসিংদী রায়পুরার M.L.A., ঢাকা জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান ঢাকাস্থ নবাব পরিবারের যোগ্য সন্তান জনাব এস. এ. সেলিম। অনুষ্ঠানের অতিথি তৎকালীন নারায়ণগঞ্জের S.D.O. পশ্চিম পাকিস্তানের সন্তান এস. এইচ. কোরায়শী C.S.P.। জনাব কোরায়শী নরসিংদীতে কলেজ প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন এবং কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সভায় প্রস্তাব সমর্থিত হয় এবং উপস্থিত সুধীজনদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ব্রাহ্মন্দীর জনাব রুস্তম আলী আশরাফী, বৌয়াকুড়ের ডা. আবদুল হেকিম, দত্তপাড়ার জনাব মতিউর রহমান প্রমুখ। মহকুমা প্রশাসকের উত্থাপিত প্রস্তাব বাস্তবায়নকল্পে ঐ-সভায়ই ১৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি সাময়িক ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হয়। যার সদস্যরা হলেন মহকুমা প্রশাসক (নারায়ণগঞ্জ), সাব-রেজিস্টার (নরসিংদী) জনাব বেলায়েত হোসেন (মাস্টার), জনাব আবদুল গফুর, জনাব আফছার উদ্দিন সরকার, মৌলবী তোফাজ্জল হোসেন, জনাব আফছারউদ্দিন ভূঞা, জনাব হাতেম আলী কাজী, জনাব রুস্তম আলী আশরাফী, ডা. আবদুল হেকিম, বাবু মধুসূদন চক্রবর্তী, বাবু জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিক। কলেজ প্রতিষ্ঠার এই প্রাথমিক উদ্যোগের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, নরসিংদীর স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সাথে যুক্ত হয়েছিলো তৎকালীন সময়ের সরকারি কর্মচারীবৃন্দ এবং একটি সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে নরসিংদীতে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

১২-১৩ দিনের মধ্যেই নরসিংদী থানা প্রাঙ্গণে মহকুমা প্রশাসকের সভাপতিত্বে ০৪ মে ১৯৪৯ তারিখে দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয় কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। গুরুত্বপূর্ণ এই সভায় নরসিংদী, মাধবদী, চিনিশপুর এবং ঢাকার অন্যান্য অঞ্চল হতে আরো ১৫ জন সদস্য কলেজ ব্যবস্থাপনা পরিষদের মধ্যে কো-অপ্ট করে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যাঁদের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন ঢাকার ডি.পি. সুলতানউদ্দিন আহমেদ, পরবর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়েছিলেন। বাড়ি শিবপুর থানার কারারচর গ্রামে। মাধবদীর শৈলেন্দ্র কুমার গুপ্ত রায়, পরিতোষ গুপ্ত, কুমরাদির মৌলবী আবদুল আজিজ, করিমপুরের জনাব সেকান্দর আলী (মাস্টার), চিনিশপুরের জনাব আশাবুদ্দিন ভূঞা (মধু ভূঞা) এবং দত্তপাড়ার জনাব সাদত আলী সরকার প্রমুখ। এই সভায় কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। যেমন : কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক খরচ এবং পরবর্তী পরিচালনা বাবদ খরচ মেটানোর জন্যে নরসিংদী বাজারের পাট, চাল, কাপড়, সুতা, খাদ্য সামগ্রী, তেল ইত্যাদি বিক্রয় সামগ্রী হতে মণ প্রতি ৬ পয়সা করে সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভায় কলেজের স্থান নির্বাচন, ‘প্রচার’, ‘অর্থ সংগ্রহ’— তিনটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়। তিন সদস্যবিশিষ্ট জমি ও স্থান নির্বাচন কমিটির সদস্যরা ছিলেন তৎকালীন সাব-রেজিস্টার (নরসিংদী), জনাব আফছারউদ্দিন ভূঞা, বাবু জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিক। প্রচার কমিটিতে ছিলেন সার্কেল অফিসার (নরসিংদী), জনাব বেলায়েত হোসেন, মৌলবী তোফাজ্জল হোসেন। অর্থ সংগ্রহ কমিটিতে ছিলেন সার্কেল অফিসার (নরসিংদী), ইন্সপেক্টর সিভিল সাপ্লাই (নরসিংদী), বাবু মধুসূদন চক্রবর্তী, আফছার উদ্দিন সরকার, জনাব বেলায়েত হোসেন এবং জনাব আবদুল গফুর। কলেজের জন্যে সংগৃহীত সমস্ত অর্থ তৎকালীন হাবিব ব্যাংক (নারায়ণগঞ্জ) এবং রায়পুরা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকে জমা রাখার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। ২১ মে ১৯৪৯ তারিখে কলেজ প্রতিষ্ঠার তৃতীয় সভায় অর্থ সংগ্রহের জন্যে টিকেটের বিনিময়ে একটি চ্যারেটি শো করার ব্যবস্থা নেয়া হয়।

ব্রাহ্মন্দীর জমিদার বাবু জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিক ব্রাহ্মন্দীস্থ তার জায়গা হতে কলেজের জন্যে ১০ বিঘা (বর্তমান মূল্যে শত কোটি টাকা) জমিদানের যে-ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, তাতে ০৮ জুলাই ১৯৪৯ তারিখে ব্যবস্থাপনা পরিষদের চতুর্থ সভায় বাবু জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিককে আন্তরিক অভিনন্দন জানানো হয়। সভায় কলেজ পরিচালনা পরিষদের সদস্য জনাব বেলায়েত হোসেন সাহেবকেও অভিনন্দিত করা হয় কলেজ গঠনের প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা প্রদান করবেন বলে। এই তারিখের সভায় ৪৯-৫০ শিক্ষাবর্ষ হতেই সাটিরপাড়া গার্লস হাই স্কুলের পরিত্যক্ত ঘরগুলোতে কলেজের ক্লাশ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৫৫ সালে ব্রাহ্মন্দীতে কলেজের নিজস্ব ভবনে কলেজ স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত গার্লস স্কুলে কলেজের কার্যক্রম চালানো হয়। প্রথম পর্যায়ে শুধু আই.এ. এবং আই.কম শ্রেণির ক্লাশ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

কলেজ প্রতিষ্ঠা
২৩ অক্টোবর ১৯৪৯ তারিখে কলেজে ব্যবস্থাপনা পরিষদের সপ্তম সভা অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় জেলা পরিষদ ডাক বাংলোয় এবং সভাপতিত্ব করেন মহকুমা প্রশাসক জনাব এস. এইচ কোরায়শী। এই সভাটিও কলেজ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে একটি স্মরণীয় সভা। সভায় কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ, অধ্যাপক এবং কর্মচারীদের নিয়োগ দান করা হয়। যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ পান কালিপদ সেনগুপ্ত ১৫০ (একশত পঞ্চাশ) টাকা মাসিক বেতনে। আরো ৫০ (পঞ্চাশ) টাকা বেতনে নতুন অধ্যক্ষের নিয়োগের র্পূব পর্যন্ত তাকে অধ্যক্ষের দায়িত্বভার দেয়া হয়। অবশ্য পরবর্তী সময়ে কালিপদ সেনগুপ্ত অধ্যক্ষের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আরবি, ফারসি এবং উর্দুর অধ্যাপক হিসেবে রুস্তম আলী দেওয়ান, ইতিহাস এবং পৌরনীতির অধ্যাপক হিসেবে এম. এ. জিলানী, অর্থনীতি ও বাণিজ্যের অধ্যাপক হিসেবে মতিন আহমেদ খান, বাংলার প্রভাষক হিসেবে রবীন্দ্র মৌলিক নিয়োগ পান। কলেজের প্রথম কেরানী হিসেবে ৬০ (ষাট) টাকা বেতনে আবদুর রহিম এবং প্রথম বেয়ারা হিসেবে ২৫ (পঁচিশ) টাকা বেতনে খোয়াজকে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৪৯ সালের ১৩ অক্টোবরের সভায় শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ এবং তিনদিন পর ক্লাশ শুরুর মধ্য দিয়ে এলাকাবাসী ও উদ্যোক্তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তব রূপ নেয়। এলাকাবাসী, সরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী শ্রেণি সকলের প্রচেষ্টায় ‘নরসিংদী কলেজ’ নামে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিদ্যাপীঠটি এ-এলাকায় শিক্ষার আলো বিস্তারে যাত্রা শুরু করে। বর্তমান সময়ে যেখানে ইউনিয়ন পর্যায়েও কলেজ রয়েছে, তখন শুধু নরসিংদী থানায় নয়, নরসিংদী-রায়পুরা-মনোহরদী-রূপগঞ্জ-আড়াইহাজার-কালিগঞ্জ-জয়দেবপুরসহ বিস্তৃত অঞ্চলে কোনো কলেজ ছিলো না। এ-সমস্ত এলাকা হতে শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে ‘নরসিংদী কলেজ’-এ এসে পড়াশোনা করতো।

১৯৫৫ সালে ব্রাহ্মন্দীতে কলেজের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত সাটিরপাড়া গার্লস স্কুলে কলেজের কার্যক্রম চালানো হয়

জায়গীর প্রথা
বিস্তৃত এই অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা নরসিংদীতে এসে বাড়ি বাড়ি জায়গীর থেকে পড়াশোনা করতো। তখন নরসিংদী কলেজের ২-৩ মাইলের ভেতর প্রত্যেকটি বাড়িতে একটি করে লজিং মাস্টার থাকতো। কলেজ পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে অভিভাবকদের বুঝিয়ে দূরের ছাত্রদের লজিং করে দিতেন।

প্রথম ও বিভিন্ন সময়ের পরিচালনা পরিষদ
কলেজের প্রথম পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে সবারই কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনার কাজে ভূমিকা ছিলো। কিন্তু সদস্যদের মধ্যে এমন কিছু ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যাঁরা কলেজ প্রতিষ্ঠা, পরিচালনাসহ সমাজের অন্যান্য সেবামূলক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করে আজো আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। তাঁদের মধ্য থেকে প্রথমেই স্মরণ করতে হয় সুন্দর আলী গান্ধীর অনুজ জনাব বেলায়েত হোসেন মাস্টারকে। তিনি কলকাতার স্কটিস চার্চ কলেজ হতে আই. এ. পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজে বি. এ. ক্লাশে পড়াশোনা করেন। উচ্চশিক্ষিত জনাব বেলায়েত হোসেন নরসিংদীর একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হন এবং নিজেকে বিভিন্ন সামাজিক সেবামূলক কাজে যুক্ত করেন। নরসিংদী কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়ে তাঁর অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯৪৯ হতে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত দীর্ঘসময় তিনি কলেজ পরিচালনা পরিষদের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়েও কলেজ পরিচালনা পরিষদের সাথে নিজেকে যুক্ত রাখেন। মার্জিত রুচিসম্পন্ন বেলায়েত হোসেন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক এবং জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিজেকে নিয়োজিত রেখে নিরলসভাবে সমাজের সেবা করে গেছেন। তিনি নরসিংদী পাট ও চাউল ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন একাধিকক্রমে অনেক বছর।

নরসিংদী কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে জমিদাতা এবং কলেজের প্রথম পরিচালনা পরিষদের সদস্য জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিককে শ্রদ্ধা ও ঋণের সাথে স্মরণ করতে হয়। শিক্ষিত, প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক জিতেন্দ্র কিশোর মৌলিক কলেজ প্রতিষ্ঠার পূর্বে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিতে পিতার নামে ব্রাহ্মন্দী কামিনী কিশোর মৌলিক উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্রাহ্মন্দীতে ‘বন্ধু সেবাশ্রম’ প্রতিষ্ঠা করে অনেক জনহিতকর সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত করেন।

কলেজ প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে মৌলবী তোফাজ্জল হোসেন অন্যতম একজন। ব্যবসার ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত মৌলবী তোফাজ্জল হোসেন সাহেব সমাজ সেবায়ও নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। কঠোর সংগ্রাম, ধৈর্য্য ও ত্যাগের মধ‌্য দিয়ে তিনি নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেন। নরসিংদী কলেজকে একটি সুন্দর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। কলেজের জন্যে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে চাঁদা সংগ্রহ করেছেন, ছাত্রদের থাকার জন্যে বাড়ি বাড়ি গিয়ে লজিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। কলেজের নির্মাণ কাজসহ সকল কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখে কলেজটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদানকে এলাকাবাসী বিশেষভাবে স্মরণ রেখেছে।

কলেজ পরিচালনা পরিষদের প্রথম পর্যায়ের সদস্যদের মধ্যে আরো যারা অর্থ, শ্রম, মেধা দিয়ে কলেজকে গড়ে তোলার জন্যে বিশেষভাবে ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের মধ্যে দত্তপাড়ার জনাব আবদুল গফুর, আফছার উদ্দিন সরকার, ছাদত আলী সরকার, শিবপুরের আফছারউদ্দিন ভূঞা, রায়পুরা থানার দড়ি হাইরমারার হাতেম আলী কাজী, ব্রাহ্মন্দীর রুস্তম আলী আশরাফী, বৌয়াকুড়ের ডা. আব্দুল হেকিম, নরসিংদীর মধুসূদন চক্রবর্তী, কুমরাদির মৌলবী আবদুল আজিজ, করিমপুরের সেকান্দর আলী মাস্টার, চিনিশপুরের আশাবুদ্দিন ভূঞা (মধু ভূঞা)-র নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়।

কলেজের প্রথম পরিচালনা পরিষদের কয়েকজন

পরবর্তী পর্যায়ে আরো অনেক ব্যক্তি নরসিংদী কলেজকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে যাদেরকে স্মরণ করতে হয়, তাঁরা হলেন শ্রী রতিলাল সাহা, মিয়া আবদুল মজিদ, রসিক লাল পোদ্দার, মনিন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস, আদম আলী মাস্টার, খন্দকার রফিক উদ্দিন আহমেদ, জোহর আলী কমান্ডার, ডা. আলতাফ হোসেন, আবদুর রহমান ভূঞা, মুসলেহ উদ্দিন ভূঞা, গোলাম মোহাম্মদ, আবদুর রাজ্জাক ভূঞা, অছিউদ্দিন ভূঞা, আবুল হাসেম মিয়া, আতাউর রহমান ভূঞা প্রমুখ।

কলেজের বিভিন্ন সময়ের অধ্যক্ষ
একটি কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রম, শিক্ষা ও সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা এবং তত্ত্বাবধানসহ সকল কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখে যিনি প্রতিষ্ঠানের মান বৃদ্ধি করেন এবং যিনি কলেজ পরিবারের প্রধান, তিনি হলেন কলেজের অধ্যক্ষ। নরসিংদীবাসীর পরম সৌভাগ্য যে, নরসিংদী কলেজকে কেন্দ্র করে অধ্যক্ষ হিসেবে পেয়েছেন অনেক মহৎপ্রাণ এবং অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব, যাঁদের স্নেহ ও আদর্শের স্পর্শে আজ কলেজের অনেক শিক্ষার্থী জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত।

শ্রী কালিপদ সেনগুপ্ত (১৯৪৯-৫৭)

কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন বাবু কালিপদ সেনগুপ্ত। দর্শনশাস্ত্রে এম.এ.। নরসিংদী কলেজে আসার আগে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের যুক্তিবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন। বাবু কালিপদ সেনগুপ্তের মামার বাড়ি নরসিংদীর সাহেপ্রতাপ সংলগ্ন মাছিমপুর গ্রামে। মামা নরেন্দ্রনাথ রায়। নানা গুণে সমৃদ্ধ, আদর্শ, ন্যায় ও নীতি-নিষ্ঠার প্রতীক ছিলেন বাবু কালিপদ সেনগুপ্ত। শিক্ষক হিসেবেও ছিলেন অনেক উঁচু মানের। তাঁর ছাত্র বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সচিব অবসরপ্রাপ্ত মোহাম্মদ আলী সাহেবের অভিমত, বাবু কালিপদ সেনগুপ্তের মতো অধ্যক্ষ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও ছিলো দুর্লভ। নরসিংদী কলেজে তাঁর কর্মজীবনকালে প্রতিবছরই ছাত্ররা যে ভালো রেজাল্ট করেছে, তা কলেজের ইতিহাসে গর্বের সাথে স্মরণ করার মতো। তিনি শুধু অধ্যক্ষ এবং যুক্তিবিদ্যারই অধ্যাপক ছিলেন না, অন্যান্য শিক্ষকদের অনুপস্থিতিতে ইংরেজি, অর্থনীতির  তো বিষয়েও ছাত্রদের শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করেছেন। সর্বদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরতেন। থাকতেন মেঘনাপাড়ের থানা সংলগ্ন মাঝিপাড়ায়। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে কলেজের জন্যে তাঁর শ্রম-মমত্ববোধ দৃষ্টান্তযোগ্য। ব্যবহারে ছিলেন অমায়িক এবং নিজের ও সহকর্মীদের দায়িত্ব সম্পর্কে সর্বদা সচেতন এবং আপোষহীন। তাঁর সময়ে ছাত্র-শিক্ষকদের আচরণও দৃষ্টান্তযোগ্য। তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্ব, আপোষহীন দৃঢ় মানসিকতা এবং কাজের তদারকি পছন্দ না করার কারণে একপর্যায়ে কিছু সহকর্মী এবং পরিচালনা পরিষদের কিছু সদস্যদের সাথে তাঁর দূরত্ব বেড়ে যায়। একপর্যায়ে ১৯৫৬ সালে তিনি অধ্যক্ষসহ কলেজের দায়িত্ব হতে অব্যাহতি চান। কিন্তু সকলের অনুরোধে ১৯৫৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। নরসিংদী কলেজের ইতিহাসে কালিপদ সেনগুপ্ত একটি উজ্জ্বল নাম।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ (১৯৫৭-৬৫)

কলেজের দ্বিতীয় অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ উপমহাদেশের একজন অন্যতম ইসলামী চিন্তাবিদ এবং দার্শনিক। ১৯৫৭ সনে তিনি নরসিংদী কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। অধ্যক্ষ আজরফ শুধু একজন শিক্ষক হিসেবেই নয়, দার্শনিক, পণ্ডিত, সাহিত্যিক এবং হৃদয়বান মানুষ হিসেবে সুধীমহলে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাঁর দার্শনিক মনভোলা আচরণ এবং সুন্দর জীবনের বহু ঘটনা আজো তাঁর প্রিয় ছাত্রদের মুখে মুখে শুনতে পাওয়া যায়। অধ্যক্ষ আজরফের সময়েও কলেজটি শিক্ষার পরিবেশ, পরীক্ষায় ভালো ফল লাভসহ অনেক উন্নতি লাভ করে। তাঁর আমলে ১৯৫৮ সালে কলেজের বি.এ. কোর্স, ১৯৬০ সালে বি.কম এবং ১৯৬২ সালে আই.এস.সি. কোর্স চালু করা হয়। নরসিংদী কলেজের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক তাঁর মতো অধ্যক্ষ পেয়ে ধন্য। ১৯৬৫ সালে কলেজের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে তিনি কলেজ হতে অব্যাহতি নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৬৭ সালে ঢাকায় আবুজর গিফারী কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন।

অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের পর ১৯৬৫ হতে ১৯৬৯ পর্যন্ত জনাব মো. রফিকুল আলম, জনাব কে. এম. আশরাফ হোসেন এবং জনাব আ. জলিল মিয়া পরপর নরসিংদী কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যক্ষ কে. এম. আশরাফ হোসেনের সময়কালে ১৯৬৭ সালে কলেজে বি.এস.সি. কোর্স চালু হয়। তিনি পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। অধ্যক্ষ আব্দুল জলিলও পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন।

আবদুর রউফ (১৯৬৯-৭২)

১৯৬৯ সালে জাতির এক বিশেষ ক্রান্তিলগ্নে নরসিংদী কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন জনাব আবদুর রউফ। ভৈরবে জন্মগ্রহণকারী জনাব আবদুর রউফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিষয়ে এম.এ.। ১৯৬২ সালে তিনি পাকিস্তান নৌ-বাহিনিতে যোগদান করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ আবদুর রউফ স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের সাথে জড়িত হন এবং ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে গ্রেফতার এবং আগরতলা মামলায় আসামী করে। বঙ্গবন্ধুর সাথে ১৪ মাস কারাবাসের পর ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানে তিনি মুক্তিলাভ করেন এবং নতুন কর্মজীবনের উদ্দীপনা নিয়ে ১৯৬৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর নরসিংদী কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। তখন সামাজিক-রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিকতায় কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন, নকলমুক্ত সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ নির্মাণ ছিলো একটি চ্যালেঞ্জ। অধ্যক্ষ আবদুর রউফ সে-চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং কলেজের সার্বিক উন্নয়ন, ভৌতিক অবকাঠামো নির্মাণসহ নকলমুক্ত শিক্ষার পরিবেশ নির্মাণে সফল হন। অত্যন্ত দক্ষতা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে ছাত্রনেতা, পরিচালনা পরিষদের সে-সময়কার জাঁদরেল সদস্যদের মোকাবেলা করেন এবং সুধীমণ্ডলে কিংবদন্তীর নায়করূপে সমাদৃত হন। তাঁর সৌভাগ্য, কলেজের অধ্যক্ষ দায়িত্বকালীন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়। সে-যুদ্ধে অধ্যক্ষ আবদুর রউফের অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং যুদ্ধের একজন সফল সংগঠক ছিলেন তিনি। স্বাধীনতার পর তিনি আবার নৌ-বাহিনিতে যোগদান করেন।

এম. ইউ. ভূঞা (১৯৭২-৮০)

অধ্যক্ষ আবদুর রউফের পর কলেজে যোগদান করেন আরেক পিতৃপ্রাণ পুরুষ জনাব এম. ইউ. ভূঞা। ইংরেজিতে এম.এ. জনাব এম. ইউ. ভূঞা। নরসিংদী কলেজের আগে কুষ্টিয়াসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যক্ষ এম. ইউ. ভূঞা কলেজের উন্নয়নের জন্যে আন্তরিকভাবে কাজ শুরু করেন। তাঁর আমলে ১৯৭৪ সালে বাংলা বিষয়ে অনার্স চালু হয়। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আবদুল মতিন চৌধুরী ছাত্র সংসদের অভিষেক অনুষ্ঠানে অনার্স কোর্স চালুর ঘোষণা দেন।। অধ্যক্ষ এম. ইউ. ভূঞা লেখায়, বক্তৃতায় সমভাবে পারদর্শী ছিলেন। সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ নির্মাণে তাঁর অবদান স্মরণ করার মতো। ১৯৮০ সালে কলেজ জাতীয়করণ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৮০ সালে কলেজটি জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয়করণের পর প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন জনাব মো. আলেম আলী। তারপর দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক আবদুল আজিজ, অধ্যাপক মো. আসাদুজ্জামান, অধ্যাপক শামসুর রহমান, অধ্যাপক শফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক মোহাম্মদ ইসহাক।

১৫ নভেম্বর ১৯৯৭ হতে অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন প্রফেসর সূর্য্যকান্ত দাস। কলেজটি সরকারিকরণের পর যাঁরা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই যাঁর যাঁর মেধা দিয়ে কলেজের উন্নতির জন্যে চেষ্টা করেছেন। তবু বিশেষভাবে অধ্যক্ষ আবদুল আজিজ ও অধ্যক্ষ শামসুর রহমানের কথা স্মরণ করতে হয়। যাঁরা আন্তরিক এবং পরিকল্পিতভাবে কলেজে শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টিতে ভূমিকা রেখেছেন।

নরসিংদী কলেজের উপাধ্যক্ষ
নরসিংদী কলেজের প্রথম উপাধ্যক্ষ জনাব রুস্তম আলী দেওয়ান। তিনি কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে অধ্যাপক হিসেবে চাকুরিতে যোগদান করেন এবং দীর্ঘদিন কলেজের উপাধ্যক্ষের পদে আসীন ছিলেন। উপাধ্যক্ষের পদে পরবর্তীতে আসেন ইংরেজির অধ্যাপক আলীম উদ্দিন মণ্ডল। স্বাধীনতা-উত্তরকালে উপাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্বভার নেন কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউছুপ। ১৯৮০ সালে সরকারিকরণের পূর্ব পর্যন্ত তিনি উপাধ্যক্ষের দায়িত্বে ছিলেন। কলেজ সরকারিকরণের পর প্রথম উপাধ্যক্ষ ছিলেন প্রফেসর আতহার আলী দেওয়ান। তারপর আসেন প্রফেসর আসহাবউদ্দিন আহমেদ। ব্যতিক্রম মানুষ ছিলেন প্রফেসর আসহাবউদ্দিন। প্রাণিবিদ্যার শিক্ষক হয়েও সাহিত্য, রাজনীতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, এমন কোনো বিষয় ছিলো না, যে-বিষয় তিনি জ্ঞান রাখতেন না। সব বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। যেমন ব্যক্তিত্ব, তেমনি দায়িত্ব-সচেতন। সৎ জীবনযাপনে অভ্যস্ত এই মানুষটি অকালে দূরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা কলেজে কর্মরত থাকাকালীন মৃত্যুবরণ করেন। তারপর আরো বেশ কয়েকজন উপাধ্যক্ষ কলেজে দায়িত্ব পালন করেন। পঞ্চাশ বৎসর পূর্তির প্রাক্কালে উপাধ্যক্ষের পদে চাকুরিরত অবস্থায় অবসর নেন কলেজের দীর্ঘদিনের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ূন কবির।

নরসিংদী কলেজের শিক্ষকবৃন্দ
নরসিংদী কলেজের শিক্ষকদের দিকে তাকালে দেখা যাবে, অনেক গুণী শিক্ষক এ-কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। কালিপদ সেনগুপ্ত অধ্যক্ষ হয়েও নিজে নিয়মিত ক্লাশ নিতেন। প্রথম পর্যায়ের শিক্ষকদের মেধা-দক্ষতা এবং শিক্ষকসুলভ বিচিত্র গুণের কথা শোনা যায় তাঁদের ছাত্রদের কাছে। রুস্তম আলী দেওয়ান, এস. এ. জিলানী, এম. এফ. হোসেন, বদরুল আলম আনসারী, মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী, রাশিদুল হাসান, আলীম উদ্দিন মণ্ডল, হাসান আল আলভী, সিরাজুল ইসলাম আমিন, মতিউর রহমান, ওয়াহিদউদ্দিন আহমেদ, ভবতোষ চৌধুরীর মতো অনেক গুণী শিক্ষক এ-কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। আজ অনেকে প্রয়াত। অনেকে জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কেউ সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, কেউ দেশের বাইরে খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। ১৯৫৫-৫৬ সময়কালে ইংরেজির অধ্যাপক রাশিদুল হাসান পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার-আলবদর বাহিনির হাতে শহীদ হন।

কলেজের মেধাবী ছাত্র
নরসিংদী কলেজের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়কাল হতেই রেকর্ড পরিমাণ ভালো। ১৯৪৯-৫০ শিক্ষাবর্ষের কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা আই.এ., আই.কম পরীক্ষা দিয়েছে ১৯৫১-৫২ শিক্ষাবর্ষে। কলেজের প্রথম পরীক্ষার্থীরাই সারাদেশের মধ্যে রেকর্ড স্থান দখল করেছে। ভালো ফলাফলের গৌরব এবং গর্ব দিয়েই কলেজের যাত্রা। সেজন্যে সে-সময়কার অধ্যক্ষ এবং অধ্যাপকদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয়। তখন বোর্ড প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সমস্ত উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। প্রথম অধ্যক্ষ কালিপদ সেনগুপ্ত কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ হতে নরসিংদী কলেজে আসেন। সেজন্যে তিনি পূর্বপরিচিত কলেজ কেন্দ্রেই তাঁর ছাত্রদের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা করেন। প্রথমদিকের বেশ কয়েকটি ব্যাচ গুরুদয়াল কলেজে আই.এ., আই.কম পরীক্ষা দিয়েছে। ১৯৫১-৫২ শিক্ষাবর্ষে কলেজের প্রথম ব্যাচের পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় সারা দেশ হতে আই.কম পরীক্ষায় মো. আবদুল মালেক ভূঞা প্রথম বিভাগে ৮ম স্থান এবং নাজির উদ্দিন আহমেদ প্রথম বিভাগে ১৩তম স্থান দখল করেন। এরপর প্রতি বৎসরই প্রথম বিভাগে পাশ করা ছাত্রদের সংখ্যাও রেকর্ড পরিমাণ। যা ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায়। ১৯৫৫-৫৬ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র, যাঁরা ১৯৫৬-৫৭ শিক্ষাবর্ষে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে, তাঁদের মধ্যে জনাব মোহাম্মদ আলী সারাদেশে আই.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ৯ম স্থান, জনাব মতিউর রহমান প্রথম বিভাগে ২৪তম স্থান এবং একই শিক্ষাবর্ষে আই.কম পরীক্ষায় জনাব ফয়েজ উদ্দিন আহমেদ প্রথম বিভাগে ৯ম স্থান দখল করেন।

জনাব মোহাম্মদ আলী নরসিংদী পৌর এলাকার দত্তপাড়া গ্রামের সুযোগ্য সন্তান। আই.এ. পরীক্ষায় ভালো ফল লাভ করে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স এবং এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। প্রথম জীবনে কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর মেধার স্বাক্ষর নিয়ে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। মহকুমা প্রশাসক, জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র এবং পদ অতিক্রম করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। যমুনা সেতু বিভাগের সচিব হিসেবে তাঁর কর্মদক্ষতা উল্লেখ করার মতো। চাকুরি জীবনের শেষপর্যায়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন।

জনাব মতিউর রহমান শিবপুর থানার শাষপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৫-৫৭ সময়কালে নরসিংদী কলেজ হতে ভালো ফল নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনের শুরুতে নরসিংদী কলেজেই ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা শুরু করেন। ছাত্রজীবনে নরসিংদী কলেজের ছাত্র সংসদের তিনি প্রথম নির্বাচিত সহ-সভাপতি। ১৯৬৪ সালে সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদে তিনি আসীন হতে থাকেন। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে সচিবের দায়িত্ব পালন করে তিনি সচিব হিসেবে কর্মরত অবস্থায় সরকারি চাকুরি হতে অবসর গ্রহণ করেছেন।

জনাব ফায়েজ উদ্দিন আহমেদ মনোহরদীর সৈয়দপুরের সন্তান। নরসিংদী কলেজ হতে ভালো ফল নিয়ে পাশ করে তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বাণিজ্যে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনের প্রথম পর্যায়ে পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাংকে চাকুরি শুরু করেন, যা বাংলাদেশে সোনালী ব্যাংকে পরিণত হয় এবং সোনালী ব্যাংকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে তাঁর সরকারি চাকুরি-জীবনের সমাপ্তি ঘটে।

এভাবে নরসিংদী কলেজের অনেক শিক্ষার্থী ভালো ফল নিয়ে পাশ করে আজ জাতীয়-আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, যা কলেজের ঐতিহ্য ও ভবিষ্যত গৌরব এবং বর্তমান প্রজন্মের ছাত্রদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

১৯৫৮-৫৯ সালের রেজাল্টও এক গৌরবময় রেকর্ড। এই শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আই.কম পরীক্ষায় কানাই লাল চন্দ্র প্রথম বিভাগে তৃতীয় স্থান এবং বিমল চন্দ্র দাস প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান দখল করেন।
১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে রমণী মোহন দেবনাথ আই.কম পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান। ১৯৬৮-৬৯ শিক্ষাবর্ষে ফরিদ উদ্দিন বি.এস.সি.-তে প্রথম বিভাগে ১৯তম স্থান এবং ১৯৬৯-৭০ শিক্ষাবর্ষে বি.কম পরীক্ষায় মো. জাহাঙ্গীর হোসেন মোল্লা, স্বপন কুমার সাহা, আবদুল হামিদ, পরিমল চন্দ্র দাশ প্রথম বিভাগে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করেন।
১৯৭৪ সালে বাংলা অনার্স কোর্স চালুর পর অনার্স শ্রেণিতে ভালো ফলের রেকর্ডও কলেজের রয়েছে। ১৯৭৮ সালে মোতাহারুল আশরাফ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজসমূহের মধ্যে বাংলা সম্মান শ্রেণিতে দ্বিতীয় বিভাগে প্রথম স্থান এবং তারপর শাহনেওয়াজ পারভীন, আবু তাহের বেলাল প্রমুখ ছাত্ররা বিভিন্ন শিক্ষাবর্ষে ভালো ফল নিয়ে অনার্স, মাস্টার্স শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।

ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে নরসিংদী কলেজ
বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মহান স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা অনেক আন্দোলনের সোপান বেয়ে অর্জিত হয়েছে। স্বাধীনতার মূল শক্তি ছিলো বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা। এই চেতনার প্রথম আন্দোলনগত স্ফুরণ ঘটে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোর মাত্র কয়েক বছর পূর্বে নরসিংদী কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো। ভাষা আন্দোলনের চেতনাবোধ নরসিংদী কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিলো। নরসিংদী কলেজের বর্তমান মূল ভবনের আঙিনায় ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্যোগে এক স্তম্ভের একটি শহীদ মিনার গড়া হয়। বৃষ্টির পানি পরিমাপযন্ত্র এবং ছোট্টো সুন্দর বাগান-ঘেরা এই শহীদ মিনার চত্বরটি কলেজের ছাত্র আন্দোলনের অনেক সাক্ষী বহন করেছিলো। স্বাধীনতা-উত্তরকালে কলেজের বিজ্ঞান ভবনের সামনে নারিকেলতলায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে তিন স্তম্ভের একটি বড়ো শহীদ মিনার গড়ে তোলা হয়। স্বাধীনতা-উত্তরকালে ১৯৭৩ সনে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী শহীদ মিনারের নির্মাণকাজ সমাপ্তিতে শুভ উদ্বোধন করেন। আজো সেই শহীদ মিনারটি ভাষা আন্দোলনের চেতনা এবং শক্তিকে ধারণ করে শিক্ষার্থী-স্থানীয় জনগণ এবং সকল স্তরের মানুষের একুশের মিলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর মহান একুশের অনুষ্ঠান এই শহীদ বেদী এবং চত্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশাল আকারে অনুষ্ঠিত হয়। নরসিংদীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এবং কেন্দ্রীয় সমাবেশের স্থল হিসেবে এখানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক এবং এলাকাবাসী একুশের প্রথম প্রহর এবং প্রভাতে সমবেত হয় শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজেদের জাতীয় চেতনাকে উদ্দীপ্ত করার জন্যে। দেশের গানে মুখরিত হতে থাকে সমগ্র চত্বর। ব্যানার, ফেস্টুন, দেয়ালচিত্র, পোস্টার, তৈলচিত্রে সজ্জিত হয় সমগ্র এলাকা। স্বাধীনতা-উত্তরকাল হতে এমন একটি পরিবেশ রচনায় যিনি নেপথ্যে তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে কাজ করে চলেছেন, কলেজের সেই প্রাক্তন ছাত্র এবং অধ্যাপক প্রণব চক্রবর্তীকে বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়।

৫২’র ভাষা আন্দোলন পরবর্তী বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দেলনেও নরসিংদী কলেজের অবদান উল্লেখ করার মতো। ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-আন্দোলনে কলেজের ছাত্রদের ভূমিকা খুবই বলিষ্ঠ। এসব আন্দেলনের পথ ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধে নরসিংদী কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা অংশগ্রহণ করেছে। শহীদ হয়েছেন অনেক ছাত্র-শিক্ষক। অর্জিত হয়েছে বিজয়।

কলেজের ছাত্র সংসদ ও ছাত্র সংগঠন
নরসিংদী কলেজের ছাত্র সংসদের ঐতিহ্যও অনেক পুরাতন। ছাত্র সংসদ প্রথম পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ছাত্র সংগঠনের নামে নির্বাচিত হতো না। প্রগতি, নবারুণ ইত্যাদি স্থানীয় নামে ছাত্র সংসদ গঠিত হতো। কলেজ ছাত্র সংসদ ছাত্র ইউনিয়ন নামে পরিচিতি ছিলো। একপর্যায়ে কলেজ পরিচালনা পরিষদ ছাত্র সংসদের সংবিধান ও গঠনতন্ত্র অনুমোদন করেন। তখন ছাত্র সংসদের সংবিধান ও গঠনতন্ত্র অনমোদন করেন। তখন ছাত্র সংসদে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্টধারীরাই আসতে পারতো। ছাত্র সংসদের গঠনতন্ত্রেও সে-বিধান ছিলো। ছাত্র সংসদের প্রথম পর্যায়ে সহ-সভাপতি থাকতেন কলেজের একজন ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক। ১৯৫২ হতে ৫৫-৫৬ পর্যন্ত সহ-সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক রুস্তম আলী দেওয়ান। ১৯৫৬-৫৭ শিক্ষাবর্ষের প্রথম নির্বাচিত সহ-সভাপতি মেধাবী ছাত্র মো. মতিউর রহমান, যিনি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে চাকুরি হতে অবসর নেন। ছাত্র সংসদের তালিকার দিকে তাকালে দেখা যাবে কলেজের প্রাক্তন সহ-সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকদের অনেকেই আজ সামাজিক ও জাতীয়ভাবে নিজ নিজ পেশায় প্রতিষ্ঠিত ও খ্যাত। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে সহ-সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত রিয়াজউদ্দিন আহমেদ।

রাজনৈতিক দলভুক্ত ছাত্রসংগঠনের নামে কলেজের ছাত্র সংগঠন গড়ে ওঠে ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। তখন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ছিলো ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন। ১৯৬৫ সালের পরপরই ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় নামানুসারে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এবং বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) নামে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অন্যান্য সংগঠনের মধ্যে ইসলামী ছাত্রসংঘ এবং আরো পরবর্তীকালে এন.এস.এফ. নামে মুসলিম লীগ অনুসারী ছাত্রসংগঠন কলেজে গড়ে ওঠে স্বল্প সময়ের জন্যে।

কলেজে বিভিন্ন কোর্স চালুর কথা
কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরুতে ১৯৪৯ সালে শুধু আই.এ. ও আই.কম শ্রেণির কোর্স চালু ছিলো। অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সময়কালে ১৯৫৮ সালে বি.এ. শ্রেণি, ১৯৬০ সালে বি.কম এবং ১৯৬২ সালে আই.এস.সি. কোর্স চালু হয়। অধ্যক্ষ কে. এম. আশরাফ হোসেনের সময় ১৯৬৭ সালে বি.এস.সি. কোর্সে চালু হয় এবং নরসিংদী কলেজটি একটি পূর্ণাঙ্গ ডিগ্রি কলেজে পরিণত হয়।

১৯৭৪ সালে অধ্যক্ষ এম. ইউ. ভূঞার সময় বাংলা সম্মান কোর্স চালু করার মধ্য দিয়ে কলেজে সম্মান শ্রেণিতে শিক্ষাদান শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে বাংলা বিষয়ে এম.এ. প্রথম পর্ব ও শেষ পর্ব কোর্সও চালু করা হয়।

পরবর্তীতে ১৯৯৭-৯৮, ১৯৯৮-৯৯ এবং ১৯৯৯-২০০০ শিক্ষাবর্ষে কলেজে ইংরেজি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, গণিত, উদ্ভিদ ও প্রাণিবিদ্যা বিষয় নিয়ে মোট ১৩টি বিষয়ে অনার্স কোর্স চালু করা হয়। এসব বিষয়ে অনার্স কোর্সে যথাযথ পাঠদানের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং অবকাঠামোগত নির্মাণ কাজও শুরু হয়।

কলেজের ছাত্রী প্রসঙ্গ
১৯৪৯ সালে কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় কোনো ছাত্রী কলেজে ভর্তি হয়েছিলো কিনা, জানা যায়নি। প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে জিনারদীর বিজয় চ্যাটার্জির মেয়ে বীথিকা চ্যাটার্জি, ব্রাহ্মন্দীর আবদুল আলী কেরানীর মেয়ে বিলকিস জাহান মায়াসহ আরো কয়েকজন ১৯৫৮ সালে কলেজে ভর্তি হয়। সেই থেকে কলেজে প্রতি বছরই ছাত্রী বাড়তে থাকে এবং নারী শিক্ষার বিকাশ ঘটতে থাকে।

কলেজের সহপাঠ কার্যক্রম-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ক্রীড়া, সেবামূলক কাজ ইত্যাদি
নরসিংদী কলেজে একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা যেমন সুনাম অর্জন করেছেন, তেমনি সহপাঠ কার্যক্রমেও শিক্ষার্থীদের সুনাম রয়েছে। কলেজের নিজস্ব গণ্ডিতে যেমন সাহিত্য-সংস্কৃতি, ক্রীড়া ইত্যাদি কার্যক্রম চলেছে, তেমনি কলেজের প্রাক্তন ছাত্ররা কলেজের এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে অনেকে জাতীয়ভাবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ-প্রসঙ্গে সংগীত জগতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে খ্যাত আপেল মাহমুদ, নাট্যশিল্পী খালেকুজ্জামান, নূরুল ইসলাম গেন্দু, ক্রীড়া জগতে আবদুল গফুরসহ অনেকের নামই স্মরণ করা যায়।

কলেজের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ড এবং জাতীয় দুর্যোগ মোকাবেলায়ও নিজেদের যোগ্যতার সাথে সম্পৃক্ত করেছে। বিগত সময়ের বন্যা সমস্যা মোকাবেলায় কলেজের ছাত্রদের ভূমিকা প্রশংসনীয়। এসব সেবামূলক কাজে এবং কলেজের বিভিন্ন সময়ের শৃঙ্খলা রক্ষায় কলেজ রোভার ইউনিট দক্ষতার সাথে কাজ করে চলছে।

কলেজের কর্মচারীদের কথা
১৯৪৯ সালে কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নে বৌয়াকুড়ের ডা. আবদুল হেকিমের ছেলে আবদুর রহিম প্রথম কেরানী এবং খোয়াজ বেয়ারা হিসেবে কাজে যোগদান করে। এরপর কাজের পরিধি বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্রাহ্মন্দীর হাবিবুর রহমান (নূরুল ইসলাম গেন্দুর বড়ো ভাই) এবং আরো পরবর্তী সময় তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে আবদুল আজাদ খন্দকার, মাহবুবুর রহমান, আলী আকবর, মোখলেছুর রহমান মৃধা, হাফেজ মোসলেউদ্দিন, হাবিবুল্লাহ বাহার, শামসুদ্দীন আহমেদ, আবদুল আওয়াল, চুনীলাল দে প্রমুখরা কলেজের অধ্যক্ষের কার্যালয়ে কাজ করে।

নরসিংদী কলেজের ইতিহাস পর্যালোচনায় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে যে-কয়েকজনকে বিশেষভাবে স্মরণ করতে হয়, তারা হলেন খোয়াজ, পরিমল চন্দ্র দে, মনিন্দ্র চন্দ্র দে। তাদের শ্রম এবং আন্তরিকতা কলেজের ছাত্র-শিক্ষকদের স্মৃতিতে সবসময় অম্লান থাকবে। এরা শুধু চাকুরি করেনি। প্রতিষ্ঠানের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিলো প্রাণের। ধৈর্য্য এবং আন্তরিকতা নিয়ে এরা কলেজের সকল কাজে নিজেদের উৎসর্গ করেছিলো।

সমাপ্তি কথা
নরসিংদী কলেজ ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো একটি সম্মিলিত প্রয়াসে। বিগত ৭২ বছরে কলেজটি অনেক গৌরবময় ইতিহাসকে ধারণ করেছে। অনেক অতীত গৌরবের কারণে আজ ইতিহাস-ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তী সময়ে এই প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার জন্যে এলাকার আপামর জনগণ, ব্যবসায়ী শ্রেণি, শিক্ষার্থীদের অভিভাবক,. শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ মিলিতভাবে কাজ করেছেন। এই কলেজের জন্যে অনেক চাঁদা দিয়েছে জনগণ। চাঁদা উঠেছে পাট, সুতা, কাঁচামাল, তেল, চাল, সিনেমা হলের টিকিট হতে, বাড়ি বাড়ি হতে সংগ্রহের মাধ্যমে। এভাবেই এলাকাবাসীর অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে আজ কলেজ ৭২ বছর অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষাগ্রহণের উপযুক্ত হয়ে ওঠেছে। এই কলেজের ঋণ অনেকের কাছে, সবার কাছে।


তথ্যসূত্র
১. আমার জীবনকথা, মৌলবী তোফাজ্জল হোসেন
২. কলেজ পরিচালনা পরিষদের ‘রেজুলেশন বুক’
৩. বিভিন্ন বছরের কলেজ বার্ষিকী
৪. সতীর্থ সংবাদ, ঢাকা প্রবাসী নরসিংদী মহাবিদ্যালয় প্রাক্তন ছাত্র সমিতির স্মরণিকা
৫. নরসিংদী, নরসিংদী থানা জনকল্যাণ সমিতির স্মরণিকা
৬. নরসিংদীর ইতিহাস, শফিকুল আসগর
৭. আগরতলা মামলা ও আমার নাবিক জীবন, আবদুর রউফ
৮. ব্যক্তিগত সাক্ষাতকার :
    মোহাম্মদ আলী, প্রাক্তন সচিব, প্রাক্তন ছাত্র, ১৯৫৫-৫৬
    সামসুল হক, প্রাক্তন ছাত্র, ১৯৪৯-৫০
    আবদুল কাদির, প্রাক্তন ছাত্র, ১৯৪৯-৫০
    রাধারমণ সাহা, প্রাক্তন ছাত্র, ১৯৪৯-৫০
    মোখলেছুর রহমান মৃধা, প্রাক্তন ছাত্র, ১৯৫৩-৫৪
    গৌরাঙ্গ চন্দ্র পোদ্দার, প্রাক্তন ছাত্র, ১৯৫৫-৫৬
    নজরুল ইসলাম মন্টু, প্রাক্তন ছাত্র, ১৯৬৩-৬৪
    আজিজ আহমেদ খান, প্রাক্তন ছাত্র, ১৯৬৫-৬৬
    মো. ইউনুস মিয়া, প্রাক্তন ছাত্র, ১৯৫৫-৫৬
    এ. এম. মাহবুবুর রহমান, প্রাক্তন কর্মচারী প্রমুখ।


গোলাম মোস্তাফা মিয়া
সাবেক শিক্ষার্থী ও অধ্যক্ষ, নরসিংদী সরকারি কলেজ।

সম্পর্কিত

1 COMMENT

  1. নরসিংদী সরকারি কলেজ নিয়ে স্যারের লেখা টি চমৎকার। তথ্যবহুল এই লেখা টি আমাকে অনেক জানতে সহযোগিতা করবে। বালাপুর হাইস্কুল টি 1 921 সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বলে জানা গেছে। এটা 1906 সালে নয় । ধন্যবাদ ব্রহ্মপুত্র পরিবারকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here